আবু আফজাল সালেহ

  ২৪ জুন, ২০১৯

বিশ্লেষণ

টেকসই উন্নয়নে সরকারের চ্যালেঞ্জগুলো

পরিবর্তনশীল বিশ্বের সমতা ও বৈষম্যহীন উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ‘রূপান্তরিত আমাদের পৃথিবী : ২০৩০ সালের জন্য টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)’ শিরোনামে গৃহীত প্রস্তাবনা অনুমোদন হয়েছে। জাতিসংঘ সারা বিশ্বের উন্নয়ন টেকসই করতে ১৭টি লক্ষ্য (এসডিজি) নির্ধারণ করেছে। প্রতিটির ক্ষেত্রে রয়েছে আবার একাধিক সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য।

টেকসই উন্নয়ন একটি সামাজিক পরিভাষা। স্থিতিশীল উন্নয়ন বা উন্নয়নের স্থিতিশীলতা উভয় ক্ষেত্রে শব্দটির প্রয়োগ করা হয়। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ Sustainable Development|। পরিবেশকে ভিত্তি করে সংঘটিত আর্থসামাজিক উন্নয়নই হলো টেকসই উন্নয়ন। টেকসই উন্নয়ন বলতে শুধু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা পূরণের জন্য বর্তমান প্রজন্মের ভোগ সীমিতকরণকেই বোঝায় না, বরং এটি সংখ্যালঘিষ্ঠের অটেকসই ভোগের কারণে বর্তমান প্রজন্মের অবশিষ্ট জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা পূরণের প্রক্রিয়া যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, তাও নিশ্চিত করে। টেকসই উন্নয়নের আরেকটি মাত্রা হচ্ছে আন্তঃপ্রজন্মগত সমতা। অন্যকথায়, টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে সমবণ্টন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে : টেকসই উন্নয়ন মূলত একটি প্রক্রিয়া, যা দ্বারা জনগণ তাদের চাহিদা মেটায়, তাদের বর্তমান জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটায় এবং সেই সঙ্গে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে তাদের আপন চাহিদা পূরণ করতে পারে, তাদের সেই সামর্থ্যরে সুরক্ষা করে।

দেশের ভৌগোলিক অবস্থার ভিন্নরূপতা রয়েছে। উত্তরাঞ্চল যেমন খরাপ্রবণ, দক্ষিণাঞ্চল লবণাক্ততার আধিক্য ও নদীবহুলতা রয়েছে; তেমনি দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে রয়েছে দুর্গম-পাহাড়ি এলাকা। সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনা হাওর-দুর্গম এলাকা। ফরিদপুর-ভোলা-নোয়াখালীতে চরাঞ্চলের আধিক্য। যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় নদীভাঙন এলাকা বেশি। আমাদের অঞ্চলভিত্তিক এসব বাঁধাসমূহ মোকাবিলা করার জন্য আলাদা আলাদা বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য সরকার বিভিন্ন পর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এমডিজিস ইতোমধ্যে অর্জন করেছে বাঙলাদেশ। এখন ২০৩০ সালের মধ্যে ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ নির্ধারণ করা হয়েছে। এর জন্য সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, বদ্বীপ মহাপরিকল্পনা-২১০০ গ্রহণ করে এগিয়ে যাচ্ছে। বদ্বীপ মহাপরিকল্পনা-২১০০-এ অনেক কিছুই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

জনসংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু সম্পদের পরিমাণ কমছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৪০ লাখ মানুষ বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। অন্যদিকে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। নগর গড়ে উঠছে অপরিকল্পিতভাবে। বাসস্থানের বৈষম্য বেড়েই যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ বৈষম্য কিন্তু দারিদ্রতা বৈষম্যের বৃদ্ধির কথা-ই বলে। বিশ্বের ১০ ভাগ মানুষ ৯০ ভাগ সম্পদ ভোগ করছে। অন্যপক্ষে ৯০ ভাগ মানুষ ১০ ভাগ সম্পদ ভোগ করছে। বাংলাদেশেও কিন্তু এ বৈষম্য বিরাজ করছে। কিন্তু এটা আলোচনার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। এটা কিন্তু টেকসই উন্নয়নে অন্যতম অন্তরায়।

মাটির উৎপাদন ক্ষমতার একটা সীমাবদ্ধতা আছে। একটা সময় পর উৎপাদন ক্ষমতা কমতে থাকে। রাসায়নিক সার প্রয়োগে উৎপাদন ক্ষমতা কমতে থাকে। কীটনাশক প্রয়োগে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। প্রাকৃতিক সার ও জৈব পদ্ধতি ব্যবহারে জোর দিতে হবে। জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে লজিস্টিক সাপোর্টের পরিমাণ বাড়াতে হবে। সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্পগুলোকে সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য পরিকল্পনা নিতে হবে। দারিদ্র্য হ্রাসকরণ-সংক্রান্ত এমডিজি-১ লক্ষ্য অর্জনে বিশ্বে অগ্রগামী ভূমিকা পালনের জন্য বাংলাদেশ জাতিসংঘ কর্তৃক ‘বিশেষ স্বীকৃতি’ লাভ করে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বাংলাদেশকে এজন্য ‘ডিপ্লোমা অ্যাওয়ার্ড’ও প্রদান করে।

এমডিজির চতুর্থ লক্ষ্য ছিল শিশু মৃত্যুহার কমিয়ে আনা। তা ২০১০ সালেই ২০১৫-এর লক্ষ্য অর্জন করে বাংলাদেশ। এর জন্য প্রধানমন্ত্রীকে জাতিসংঘ ‘এমডিজি অ্যাওয়ার্ড-২০১০’-এ ভূষিত করে। শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার-সংক্রান্ত এমডিজি-৪ ও এমডিজি-৫-এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করেছিল। ফলে বাংলাদেশের জন্য এ দুটি লক্ষ্য অর্জন করা সহজ হয়েছিল। এ কারণে বাংলাদেশকে আরেকটি ‘সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড’-এ ভূষিত করা হয়। নারীশিক্ষায় ব্যাপক সাফল্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জাতিসংঘ হতে ‘ইউনেসকো পিস টি’ অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে। এমডিজি-৫-এর আওতায় নারীর ক্ষমতায়নে তার ভূমিকার জন্য ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করা হয় এবং ইউএন-উইমেনের পক্ষ থেকে ‘পানেট ৫০-৫০ চ্যা¤িপয়ন’ ঘোষণা করা হয়। এমডিজি-৭-এর লক্ষ্য অনুযায়ী, পরিবেশ রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা-সংক্রান্ত সাফল্যের জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনাকে তার প্রাজ্ঞ নেতৃত্বের জন্য ইউএনইপি হতে ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তাই বলা যায়, ‘মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল-২০০০’ অর্জনে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে মডেলের ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে কাজটা অনেক কঠিন। এবং সেটা মাত্র ১৫ বছরেই (২০৩০ সালের মধ্যে) করতে হবে। আমরা অবশ্য অনেক লক্ষ্যমাত্রার ক্ষেত্রে এগিয়ে আছি। পিছিয়ে পড়া বা নতুন লক্ষ্যমাত্রাগুলোর ওপর নজর বেশি দিতে হবে।

জাতিসংঘের ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সল্যুশন্স নেটওয়ার্কে’-এর এসডিজি সূচক এবং ড্যাশবোর্ডস রিপোর্ট ২০১৭ অনুযায়ী ১৫৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২০। বাংলাদেশের স্কোর ৫৬ দশমিক ২। দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, নেপাল, ভুটান র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। ৫৫ দশমিক ৬ স্কোর নিয়ে পাকিস্তান আছে ১২২ নম্বরে। আফগানিস্তানের অবস্থান ১৫০। এমডিজির ৮টি লক্ষ্য দারুণভাবে পূরণ করলেও প্রকাশিত এই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ১০টিতেই ‘লাল কার্ড’ পেয়েছে বাংলাদেশ। এসব ক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। লাল কার্ড বা পিছিয়ে থাকা ১০টি লক্ষ্যমাত্রা এসডিজি নং-২. খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টির উন্নয়ন ও কৃষির টেকসই উন্নয়ন; এসডিজি-৩. সকলের জন্য সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা; এসডিজি নং-৪. মানসম্পন্ন শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিতকরণ; এসডিজি নং-৭. সকলের জন্য জ্বালানি বা বিদ্যুতের সহজলভ্য করা; এসডিজি নং-৮. স্থিতিশীল ও অংশগ্রহণমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পূর্ণকালীন উৎপাদনমূলক কর্মসংস্থান ও কাজের পরিবেশ; এসডিজি নং-৯. স্থিতিশীল শিল্পায়ন এবং উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করা; এসডিজি নং-১১. মানববসতি ও শহরগুলোকে নিরাপদ এবং স্থিতিশীল রাখা; এসডিজি নং-১৪. টেকসই উন্নয়নের জন্য সাগর-মহাসাগর ও সামুদ্রিক সম্পদ সংরক্ষণ ও পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত করা; এসডিজি-১৬. শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক সমাজ, সকলের জন্য ন্যায়বিচার, সবস্তরে কার্যকর, জবাবদিহি ও অংশগ্রহণমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা; এবং এসডিজি নং-১৭. টেকসই উন্নয়নের জন্য এসব বাস্তবায়নের উপায় নির্ধারণ ও বৈশ্বিক অংশীদারত্বের স্থিতিশীলতা আনা। পরিসংখ্যানের সত্যতা যাই হোক, এসব ক্ষেত্রে আমাদের জোর দিতে হবে। বিশেষ পরিকল্পনা করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে এগিয়ে যেতে হবে। এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার একটি অন্যতম মূলমন্ত্র হচ্ছে, Leaving no one behind (LNOB)অর্থাৎ উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় কেউ যেন পিছিয়ে না থাকে। এ মূলমন্ত্র কাজে লাগাতে হবে।

সুষ্ঠু জাতি গঠনে ভালো মানুষ দরকার। আমাদের যুবসমাজের একটি বিশাল অংশের কেউ কেউ হতাশাগ্রস্ত, কেউ কেউ হতাশা বিলাসে মাদকাসক্ত হয়ে বিপথগামী। মাদক জাতির তরুণ সমাজের একাংশকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এর পরিমাণ বৃদ্ধিই পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর এ ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি এগিয়ে নিতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ব্যর্থ হলে অসুস্থ ও বিকারগ্রস্ত নাগরিক নিয়ে টেকসই উন্নয়ন সম্ভন নয়। সুনাগরিক তৈরির জন্য উন্নত পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে হবে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রুখে দিয়ে নিজস্ব বলয় শক্তিশালী করতে হবে। গ্রাম পর্যন্ত সুষ্ঠু সাংস্কৃতিচর্চার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এ ব্যাপারে বরাদ্দ বাড়িয়ে তার সদ্ব্যবহার করতে হবে। তদারকির হারও বাড়াতে হবে। মূলত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে সততা। সততা আর স্বচ্ছতা হচ্ছে নির্ভেজাল উন্নয়নের অন্যতম উপকরণ বা বিষয়। সৎ না হলে যত বড় উন্নয়ন পরিকল্পনাই করা হোক না কেন, তা কার্করী হবে না! উচিত কাজটি করতে হবে; সততার সঙ্গে, সাহসের সঙ্গে। মানবিক গুণাবলি ও নৈতিক মূল্যবোধে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে হবে। ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে’Ñ এ মূলমন্ত্র বাস্তবায়ন করতে হবে। তা হলেই সবক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আসবে। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। পুনর্বিন্যাস করতে হবে। প্রয়োজনে দফতর বদল করতে হবে। প্রয়োজনে শীর্ষস্থানীয় পদগুলোতে পরিবর্তন আনতে হবে।

টেকসই উন্নয়নের তূল লক্ষ্য হচ্ছে, ‘সোনার বাংলা’ গড়া। এর জন্য আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। স্বাধীনতাযুদ্ধে যেমন ‘যার যা আছে’ নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে জয় ছিনিয়ে এনেছি। সেভাবেই আমরা সবাই মিলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। চাঁদে অবতরণের সময় নীল আর্মস্ট্রং-এর অমর কথা মনে রাখতেই পারিÑ ‘......That’s one small step for man, one giant leap for mankind (...ক্ষুদ্র সব পদক্ষেপ নিয়েই বড় কিছু তৈরি হয়)।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close