হরিজনের দুর্ভাগ্যের অবসান হোক
জরাজীর্ণ পাটাতনে জন্ম। চূড়ান্ত অবক্ষয়ের নির্মম পরিবেশে বেড়ে ওঠা। অনেকের কাছে ওরা অচ্ছুত। সংগ্রহের ঝুলিতে কেবল একটি শব্দ। ‘অবহেলা’। যুগ যুগ ধরে অবহেলার চাদরে ঢাকা এক সম্প্রদায়। একসময় এদের বলা হতো মেথর। সেখান থেকে ধাঙর। তারপর হরিজন। জাতি-সম্প্রদায় হিসেবে নামের ক্ষেত্রে উল্লম্ফন হলেও জীবনযাপনের ক্ষেত্রে তার কোনো হদিসই খুঁজে পাওয়া যায় না। দেশ ও জাতি মহাকাশে স্যাটেলাইট বসিয়ে আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে যখন নিজের যোগ্যতার পরিমাপ করছে, তখন সার্বিক দুর্ভিক্ষের কবলে একটি সম্প্রদায়। এদের অভাব এতটাই বেশি যে, নিরাপত্তাহীনতার কাঁধে হাত রেখে চলতে হয় অন্ধের মতো। এদের কোনো শিক্ষা নেই। শিক্ষার প্রশ্নে এতটাই নাজুক যে, এরা জানে না সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য কতটুকু জেনে নেওয়া জরুরি। আর সে কারণেই এদের আয়ু বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুর অনেক নিচে। যদিও এরা এ দেশেরই নাগরিক।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে সেবক হিসেবে কর্মরত হরিজন সম্প্রদায়ের অনেকেই চাকরির মেয়াদ পূর্তির আগেই মারা যাচ্ছেন। এদের গড় আয়ু ৪৫ থেকে ৫০ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর বাইরেও আছে। ২০-২৫-এর মধ্যে মারা যাওয়া হরিজনের সংখ্যাও কম নয়। বর্জ্য অপসারণে সুরক্ষা ব্যবস্থা না দেওয়া ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনকে এর অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যমতে, ধারাবাহিকভাবে সুরক্ষা উপকরণ সরবরাহে ঘাটতি থাকলেও পরিধানে অনীহা। গ্লাভস, মাক্স, বুট ছাড়াই নিরন্তর বর্জ্য অপসারণের ফলে সহজেই লিভার ফুসফুসসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) হরিজন সম্প্রদায়ের সেবকরা। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস ও পুষ্টির অভাব অসুস্থতাকে আরো বেশি ত্বরান্বিত করছে। সেই সঙ্গে কাঙ্খিত চিকিৎসাসেবা না পাওয়ায় অকালেই মারা যাচ্ছেন এরা।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৬ সালের জুন থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সিটি করপোরেশন ও অন্যান্য সংস্থায় কর্মরত অবস্থায় মারা গেছেন ৪৬ জন। এর মধ্যে ২০ জন হরিজন সম্প্রদায়ের। এদের অধিকাংশ মারা গেছেন চাকরির মেয়াদপূর্তির আগে। যাদের গড় বয়স ৪৫-৫০ বছরের মধ্যে। বর্জ্য অপসারণের অধিকাংশ ক্ষেত্রে সনাতনী পদ্ধতি অনুসরণ করছেন তারা। ফলে কর্মরত থাকা অবস্থায়ই অনেকে লিভার, চর্মরোগ, যক্ষ্মা ও ক্যানসারের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বয়সটা যৌবন পেরোনোর আগেই মারা যেতে হচ্ছে। এ চিত্র দেশের সর্বত্রই। সরকারি তথ্যমতে, দেশে হরিজন সম্প্রদায়ের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। তবে বেসরকারি হিসাবমতে, ১৫ লাখেরও বেশি। আমরা মনে করি, ১৬ কোটি মানুষের দেশে সম্ভবত এ সম্প্রদায়ের মানুষরাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। মর্যাদার প্রশ্নে শূন্যের কাছাকাছি। চিন্তা ও চেতনায় প্রিমিটিভ যুগের প্রাণী বিশেষ। তবু তো বেঁচে আছে। বেঁচে ছিল এবং থাকবে। সভ্য মানুষের প্রয়োজনেই এদেরকে বাঁচিয়ে রাখা হবে। তবে সভ্য মানুষের কাছে একটি নিবেদন, এদের গড় আয়ুকে একটু প্রলম্বিত করা যায় কি না, ভেবে দেখবেন। আলোহীন মানুষকে আলোকিত করাই তো আধুনিকতার লক্ষ্য। আসুন আমরা সে লক্ষ্য সামনে রেখে আগামীর পথে এগিয়ে যাই।
"