ফারিহা হোসেন

  ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

পর্যালোচনা

ডাকসু নির্বাচন ও প্রাসঙ্গিকতা

শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি, ছাত্ররাজনীতি থাকা উচিত-অনুুচিতÑ এ নিয়ে প্রায়ই তর্ক-বিতর্ক হয়। পত্র-পত্রিকায় সংবাদ, সম্পাদকীয় নিবন্ধ, টেলিভিশনে টকশো হতে দেখা যায়। তবে এসব আলোচনা, সংবাদ, সম্পাদকীয়, টকশোর বেশির ভাগই শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি, ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে থাকে। অবশ্য যারা বিপক্ষে থাকেন তাদের যুক্তিও থাকে। তবে যারা পক্ষে থাকেন তাদের পক্ষে থাকার বক্তব্য, যুক্তি তেমন জোরালো থাকে না। এমনি সময়ে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ তথা ‘ডাকসু’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তোড়জোড় চলছে। ইতোমধ্যে ১১ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য তারিখসহ নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। দীর্ঘ ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ডাকসু নির্বাচন। এ খবর নিঃসন্দেহে আনন্দের, সুখবর এবং এটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের একটি মহৎ ও সাহসী উদ্যোগ। কারণ ডাকসু নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে নানা কথাবার্তা চলে আসছিল। বিগত সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিতে সাহস করেনি।

একটি চির সত্য কথা ভুলে গেলে চলবে না, আজ যে শিশু কাল সে বড় হয়ে সংসারের, পরিবারের, সমাজের, কোনো প্রতিষ্ঠানের, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আসীন হবে। মানুষের, দেশের সেবা করবে, কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক। জাতিকে পথ দেখাবে আলোর পথে, শান্তির পথে, কল্যাণের পথে, সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবে। আর এজন্য তাদের শিশুকাল থেকে বেড় ওঠা অবধি নিজেকে যোগ্য, সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হয়। তবে এ দায়িত্ব পরিবারের ওপর বর্তায়, সমাজের ওপর, রাষ্ট্রের ওপরও। আর এজন্যই প্রয়োজন শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি, ছাত্ররাজনীতি চালু থাকা জরুরি। কারণ ছাত্র অবস্থায় রাজনীতির হাতেখড়ি না হলে ভবিষ্যতে নেতৃত্বশূন্য হবে রাজনৈতিক দল, রাষ্ট্র পরিচালনায় আসীন হবে অরাজনৈতিক ব্যক্তি, ঠিকাদার, টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ, ব্যবসায়ী, আমলা, কামলা প্রভৃতি। বাস্তবে এখন অধিকাংশ রাজনৈতিক দলে অনেকটা উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো রাতারাতি নেতা হয়ে এমপি, মন্ত্রী হচ্ছেন অরাজনৈতিক ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, আমলা, ঠিকাদার, ব্যাংকার, ঋণখেলাপি, ব্যাংকখেলাপি। এধারা চলতে থাকলে রাজনীতির চেয়ে দেশের ও জনগণের ক্ষতি হবে বেশি এবং দীর্ঘমেয়াদি। এ শ্রেণি-পেশার লোক নেতা হলে, দলের ও দেশের হাল ধরলে তাদের স্বার্থ দেখবে আগে, পরে জনগণের ও রাষ্ট্রের। অবশ্য সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ অকপটে এ বিষয়ে সহজ সরল স্বীকারোক্তি এবং অনেকটা খেদোক্তি করেছিলেন। রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতে না থাকলে জনগণের কল্যাণ সুদূর পরাহত হয়। কাজেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি, ছাত্ররাজনীতি থাকা উচিত। আজ যে ছাত্র এক দিন তাকেই দেশের, জাতির হাল ধরতে হবে। নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। এ সঙ্গে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির পাশাপাশি দেশের সব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতৃত্ব নির্বাচনে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা দরকার। তবে ছাত্ররাজনীতি হওয়া উচিত শুধু ছাত্রদের সমস্যা এবং শিক্ষা-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। কোনো অবস্থাতেই রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি নয়। তখনই এসব ছাত্রনেতা পরবর্তীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হয়ে দেশ পরিচালনায় তাদের ভূমিকা রাখতে সমর্থ হবেন। তখন অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের স্থলে রাজনীতিতে, রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্ব নেবেন প্রকৃত রাজনীতিবিদরা। এখানে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে লিখতে গিয়ে প্রাসঙ্গিকভাবেই কথাগুলো বলা।

প্রসঙ্গত, বিগত সময়ে অনেক নেতাই ছাত্ররাজনীতি থেকে জাতীয় রাজনীতিতে এবং দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন, এর বহু নজির রয়েছে। এ তালিকায় স্বয়ং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উল্লেখ করা যায়। এরই ধারাবাহিকতায় জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এ ছাড়াও নেতৃত্ব দিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ, মরহুম আবদুর রাজ্জাক, ওবায়দুল কাদের, ড. হাছান মাহমুদ, আ স ম আবদুর রব, মরহুম আবদুুল কুদ্দুস মাখন, আবদুল মান্নান, আখতারুজ্জামান, জিয়া উদ্দিন আহমদ বাবলু, মাহমুদুর রহমান মান্না, জাহাঙ্গীর কবীর নানক, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, আবদুর রহমান, এনামুল হক শামীম, বিএনপি নেতা আমান উল্লাহ আমান, খায়রুল কবির খোকনসহ এমন আরো অসংখ্য নেতার নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। যারা ছাত্ররাজনীতি থেকে জাতীয় রাজনীতিতে অধিষ্ঠিত হয়ে দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন।

এবার আসি মূল প্রতিপাদ্যে। ২৮ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবেই গ্রহণ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সারা দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রচর্চার একটি রুদ্ধ ক্ষেত্র অবারিত হবেÑ এমনই মনে করেন সংশ্লিষ্ট সবাই। ছাত্র সংসদের দায়িত্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষা করা এবং সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শিক চর্চার ক্ষেত্রকে স্বপ্রাণিত রাখা। আশা করা যায়, ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হবে।

ডাকসু নির্বাচন ঘোষণার পর বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নির্বাচনকেন্দ্রিক তৎপরতা বাড়ে। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দেয়। তবে ভোটগ্রহণ কোথায় হবে, তা নিয়ে সংগঠনগুলোর মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। আগের মতো আবাসিক হলে স্থাপিত ভোটকেন্দ্রে ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে ছাত্রলীগ। কিন্তু ছাত্রদল ও বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলো চায় একাডেমিক ভবনে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হোক।

এ মতান্তরের মধ্যেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে গত সোমবার। আগামী ১১ মার্চ নির্বাচন। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় ২৬ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টা; প্রত্যাহারের শেষ সময় ২ মার্চ। প্রার্থী তালিকা ৩ মার্চ এবং চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে ৫ মার্চ। সকাল ৮টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ করা হবে।

পদাধিকার বলে ডাকসুর সভাপতির দায়িত্বে থাকেন উপাচার্য। বাকি ২৫টি পদে নির্বাচন হবে। একই সঙ্গে হল সংসদের ১৩টি পদে নির্বাচন হবে। আবাসিক হলের প্রাধ্যক্ষের কার্যালয় হতে ১৯ থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মনোনয়নপত্র দেওয়া হবে। ২৬ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টার মধ্যে হলের রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দিতে হবে। ওই দিনই মনোনয়নপত্র বাছাই করা হবে। হল সংসদ নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র বিতরণ, জমা, বাছাই ও প্রত্যাহার কেন্দ্রীয় সংসদের জন্য নির্ধারিত সূচি অনুযায়ীই হবে।

ডাকসু নির্বাচন শিক্ষাঙ্গনে, রাষ্ট্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে সবাই এ আশা করছেন। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে কিছু সংশয় দেখা দিয়েছে। তফসিলকে ছাত্রলীগ স্বাগত জানালেও ছাত্রদল ও বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলো আপত্তি জানিয়েছে। আবাসিক হলে নাকি একাডেমিক ভবনে স্থাপিত ভোটকেন্দ্রে ভোট গ্রহণ করা হবেÑ এ নিয়েই আপত্তি। আপত্তিকারীরা বলছেন, আবাসিক হলে ভোটকেন্দ্র হলে পেশিশক্তি চর্চার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে ভোট সুষ্ঠু হবে না। এটা মোটেও সঠিত কথা নয়, এ অভিযোগ অমূলক। কারণ ডাকসুর গঠনতন্ত্রেই এ ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবেই বলা আছে হলেই ভোট করতে হবে। বরং হলের বাইরে ভোট হলে বহিরাগত মাস্তান, সন্ত্রাসীদের আদিপত্য বিস্তারের আশঙ্কা থাকে। কাজেই সুষ্ঠুু ও অবাধ, সকলের অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ঢাবির প্রতিটি হলেই ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা করা হবে সমীচীন ও যুক্তিযুক্ত।

আমরা চাই, শিক্ষাঙ্গনে গণতন্ত্র ও মুক্তচিন্তার চর্চাক্ষেত্র আবারও উন্মুক্ত, প্রসারিত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সচেষ্ট হবে। এ সঙ্গে সব ছাত্র সংগঠনও দায়িত্বশীল ভূমিকা নেবে এবং ক্যাম্পাসে সহাবস্থান, সব পক্ষের বক্তব্য শুনে ডাকসু নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা হোক। এ জন্য সব ছাত্র সংগঠন, রাজনৈতিক দলসমূহ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্মিলিত উদ্যোগ, অন্তরিকতা অপরিহার্য। বহুল প্রত্যাশিত ডাকসু নির্বাচনী প্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজের প্রত্যাশা করছি।

লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close