ডা. এস এ মালেক

  ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৮

নিবন্ধ

মহান বিজয় ও আজকের বাস্তবতা

প্রতি বছর ডিসেম্বর এলেই আমরা বিজয় দিবস পালন করি। এরূপ সর্বাত্মক বিজয় অর্জন বাঙালি জাতির ভাগ্যে শুধু একবারেই ঘটেছে। এ দেশের মাটিতে এক মহান সন্তান জন্মেছিলেন বলেই বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীন হয়েছে সহস্র বছরে প্রায় কয়েকবার কিন্তু ৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর জাতিসত্তাভিত্তিক যে জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; যা এর আগে কখনো হয়নি। শেখ মুজিব এক অবিস্মরণীয় নেতা; যিনি বাঙালি জাতিকে তার অস্তিত্বের সংকট থেকে উদ্ধার করেছেন। দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রামের ফসল আজকের বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি মাত্র সাড়ে তিন বছর শাসন করতে পেরেছেন। তারপর তাকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবস্থান নিয়েছিল; তারাই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী। শুধু হত্যা করাই তাদের লক্ষ্য ছিল না। ৭১-এর মহান বিপ্লবের বিপরীতে তারা প্রতিবিপ্লব ঘটিয়েছে। প্রতিবিপ্লব ঘটিয়েছিল বলেই ৭১-এর মহান অর্জনসমূহ তারা সর্বাত্মকভাবে বর্জন করেছে। তাই আমাদের মহান বিজয় এখনো সুসংহত হয়নি। যিনি দেশ স্বাধীন করলেন এবং যে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হলো, দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র সাড়ে তিন বছর পর সেই দলীয় সরকারকে বিতাড়িত করে ক্ষমতা দখল করে তারা দীর্ঘ ২১ বছর রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখে। এই সুদীর্ঘ সময় বাংলাদেশ চলেছে মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত ধারায়। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ছিল মুক্তি ও স্বাধীনতা। মুক্তি বলতে বঙ্গবন্ধু বুঝিয়েছিলেন, আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সার্বিক মুক্তি। আর প্রতিবিপ্লবীদের লক্ষ্য ছিল এই মুক্তির পথকে রুদ্ধ করা। শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের পথকে প্রতিরোধ করা। ২১ বছর ধরে ২ সামরিক শাসক ও তার অনুসারীরা সফলতার সঙ্গে প্রতিবিপ্লবের ধারায় দেশকে পিছিয়ে দিয়েছে; যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ছিল না, জনগণের আশা-আকাঙ্খার প্রতি তাদের আস্থা ছিল না, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ও স্বাধীন পতাকাকে মানত না, আমাদের মহান সংবিধানের প্রতি যাদের কোনো অঙ্গীকার ছিল না, স্বাধীন দেশকে তারা ২১ বছর শাসন করে এমন একটা অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে যে, সেখান থেকে টেনে তোলা খুব সহজসাধ্য নয়। সবচেয়ে বড় কথা, জনগণের মনমানসিকতায় বিশেষ করে তরুণ সম্প্রদায়ের চিন্তা-চেতনায় এমন কিছু ভ্রান্ত বিশ্বাস তারা প্রথিত করে গেছে, যা অপসারণ করা খুবই কঠিন। এ কারণেই দেশব্যাপী এক বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে ডাহা মিথ্যাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। ২৩ বছরের সংগ্রামের ফসল হিসেবে যিনি আমাদের স্বাধীনতা দিলেন; এমন একজন মহান ব্যক্তি প্রকৃত ঘোষক, তাঁকেও বিতর্কিত করা হয়েছে।

যিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করেন না, ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার পরও যিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আসেননি, হানাদার বাহিনীর একজন অনুগত কর্মচারী হয়ে সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তিনি যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হতেন, তাহলে সংবিধান থেকে ৪ মূলনীতি পরিবর্তন করতে যাবেন কেন? তার দলের লোকরা তাকেই স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে প্রচারের অপচেষ্টা চালাবে কেন। একটা স্বাধীন দেশে যদি প্রতিবিপ্লবীরা স্বাধীন হওয়ার পরপরই ২১ বছর প্রতিবিপ্লবী ধারায় শাসন করে; তাহলে সে দেশের জনগণ স্বাধীনতার সুফল ভোগ করবে কী করে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে দেশ স্বাধীন হলো, সেই স্বাধীনতাকে অর্থহীন করে দিল স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। জেনারেল জিয়াই

যে প্রতিবিপ্লবের প্রকৃত নেতৃত্বে ছিলেন; তা অনুধাবন করা যায়। তার শাসনামলে একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে স্বাধীনতার শত্রু গোলাম আযমসহ খুনিদের পুনর্বাসিত করতে গেলেন কেন? যিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী নন; তিনি জাতিসত্তায় বিশ্বাসী হন কী করে।

বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবর্তন করে, ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শকে পরিবর্তন করে, সাম্প্রদায়িকতার উসকানি দিয়ে জিয়া প্রমাণ করেছেন, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার দাবি করার অধিকার নেই। জিয়া বাংলাদেশকে জাতিরাষ্ট্র থেকে ধর্মরাষ্ট্রে রূপান্তর করতে চেয়েছিলেন। তার লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধু, যা যা অর্জন করেছেন তা ধ্বংস করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তানে রূপান্তর করতে। আর এটা করতে হলে জামায়াতকে যে সঙ্গে নিতে হবে, তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছিলেন বলেই গোলাম আযমের পুনর্বাসন করেন। দেশ স্বাধীন হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ দশক। কিন্তু স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে একটা মহল এখনো প্রশ্নের সম্মুখীন করে রেখেছে। সুযোগ পেলে ওরা জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার পরিবর্তন করতে দ্বিধাবোধ করবে না।

এ দেশে অনেক দল ও নেতা আছে; তারা গণতন্ত্রের কথা বলেছেন, তাদের গণতন্ত্রের প্রতি কোনো আস্থা নেই। গণতন্ত্র বলতে তারা এমন এক শ্রেণির কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চান; যাদের কথা বলার অধিকার এর আগেই প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু যাদের কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করেছিলেন; তাদের সে অধিকার আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি প্রভৃতি বড় বড় দেশে জনগণ যে গণতন্ত্রের অধিকার ভোগ করছে, সে সম্পর্কে তারা অবহিত আছেন এবং সেই ধরনের গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষ যে গণতন্ত্র দাবি তারা জানিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ সেই অধিকারের স্বাদ এখনো পায়নি। গণতন্ত্রের ভাষা তাদের কাছে বোধগম্য নয়, গণতন্ত্র সম্পর্কেই জানেন না। বঙ্গবন্ধু মৃত্যুঞ্জয়ী। শুধু বাংলাদেশ কেন পৃথিবীর ইতিহাস থেকে তার নাম মুছে ফেলা যাবে না। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। তাদের সেই স্বপ্ন ব্যর্থ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন তাই তিনি চিরদিন কোটি কোটি বাঙালির হৃদয়ে চিরজাগ্রত থাকবেন। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন, শোষিত-বঞ্চিত মানুষের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে। তাঁর সুযোগ্য মেয়ে শেখ হাসিনা একই কাজটি করে যাচ্ছেন। তার দৃষ্টি শোষিত-বঞ্চিত-মেহনতী মানুষের দিকে। এত প্রতিকূলতার মুখেও শেখ হাসিনা শোষিত-বঞ্চিত বাঙালির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। যারা হাসতে জানে না; তাদের মুখে হাসি ফোটানার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। ১৯৭১-এ যে মহান বিজয় আমরা অর্জন করেছিলাম, বারবার সে বিজয় ছিনতাই করার উপক্রম হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তারই সুযোগ্য মেয়ে এ দেশের কান্ডারি হিসেবে রাজনৈতিক দায়িত্ব গ্রহণ না করলে প্রতিবিপ্লবের

ধারা থেকে বাংলাদেশকে উদ্ধার করা সম্ভব হতো না। তাই স্বাধীনতাকে সুরক্ষা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে

শেখ হাসিনার অবদান অবিস্মরণীয়। একমাত্র তিনিই পারেন ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির জনক তার ঐতিহাসিক ভাষণে যে মুক্তি ও স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়ন করতে। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি বক্তব্য শেখ হাসিনার হৃদয়ে গাঁথা। যে লক্ষ্য নিয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন; শেখ হাসিনার লক্ষ্যও একই। বাংলার মানুষের মুক্তি। ওই মুক্তি এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব বাঙালি জাতিসত্তায় বিশ্বাসী স্বাধীনতার সপক্ষের কোটি কোটি বাঙালির। আগামী নির্বাচনকে তাই স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রাম বললেও অত্যুক্তি হবে না। এ নির্বাচনে বিজয়ী হতেই হবে।

লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close