আলমগীর খান

  ১৭ নভেম্বর, ২০১৮

মতামত

গোষ্ঠীতান্ত্রিক ট্রাম্পরোগ

ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। অতএব তার দোষ-গুণ যতটা মার্কিনদের ভাবনার বিষয়, অন্য কারো ততটা না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্প অন্যদেরও মাথাব্যথার কারণ না হয়ে উপায় নেই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে যত না, তার চেয়ে বেশি নিজ নিজ দেশে একেকটা ট্রাম্প পয়দা হওয়ার কারণে। অন্য দেশে ট্রাম্প মানে কী? মানে ট্রাম্পের মনোভাব ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন নেতানেত্রী। ট্রাম্পের ফটোকপি বা নকল আছে অনেক দেশে। নিত্যনতুন আরো দেখা যাচ্ছে ও যাবে। তারা ক্ষমতায় আসছেন ও কেউ কেউ ক্ষমতার দরজায় কড়া নাড়ছেন। তারা কেউ একা নন। সব ট্রাম্প মিলে এক জোট। যেখানে যেখানে ট্রাম্প আছেন, তারা দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতান্ত্রিক, কিন্তু সাংগঠনিক কৌশলের দিক থেকে বৈশ্বিক। ট্রাম্পরা হলো গোষ্ঠীবাদী আন্তর্জাতিক। তারা অবশ্য নিজেদের জাতীয়তাবাদী বলে পরিচয় দেয়। যদিও তারা জাতীয়তাবাদকে তার মৌলসত্তা গোষ্ঠীবাদেই ফিরিয়ে এনেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয়তাবাদের যে প্রগতিশীল ভূমিকা ছিল, বর্তমানে তা নেই। বর্তমানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংখ্যালঘিষ্ঠরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বাধীনতা হরণের জন্য জাতীয়তাবাদের গোষ্ঠীতান্ত্রিক চরিত্রকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। রাষ্ট্রের কোনো সুবিধাভোগী গোষ্ঠী অন্য সবাইকে অধিকারবঞ্চিত করতে, শাসন প্রণালির বহির্ভূত রাখতে ও সংকীর্ণ আত্মপরিচয়ে নিমজ্জিত করতে উঠে পড়ে লেগেছে। যারা দেখতে বা সংস্কৃতিতে নিজেদের মতো নয়, তাদের সবার গায়ে ট্রাম্পরা ‘বিদেশি’ লেবেল এঁটে দিয়ে তাদের দেশছাড়া করতে আদাজল খেয়ে নেমেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক মধ্যবর্তী নির্বাচনে এই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি একটি কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল। সেখানে এবারকার নির্বাচনী যুদ্ধটা ছিল গোষ্ঠীতন্ত্র না বৈশ্বিক সহযোগিতাÑ এ দুয়ের মাঝে বোঝাপড়া। এ ছিল আমেরিকার সংকুচিত ও সম্প্রসারিতÑ এ দুই দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে লড়াই। সংকোচনবাদীরা গোষ্ঠীতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করেছে ও অস্ত্র হিসেবে সংকীর্ণ আত্মপরিচয়কে উসকে দিয়েছে। তারা একটি শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টান আমেরিকার স্বপ্ন দেখছে ও তা পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। ঠিক কী কারণে অতীতের সেই শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টান আমেরিকা এই মুহূর্তে তাদের কাছে আবার এত জরুরি হয়ে পড়ল? কারণ আছে আর তা জনসংখ্যার হিসাবে নিহিত। সম্প্রতি ইয়েল ল স্কুলের আইনের অধ্যাপক অ্যামি চুয়া ‘পলিটিক্যাল ট্রাইবস’ নামে একটি বই লিখেছেন; যা থেকে কিছু উদ্ধৃতাংশ গার্ডিয়ান পত্রিকায় (১ মার্চ ২০১৮) প্রকাশিত হয়। এতে তিনি লিখেছেন, ‘আমেরিকার ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা তাদের নিজ দেশে সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়ে পড়ার ঝুঁকির মুখোমুখি। আমাদের মিশ্র সংস্কৃতির শহরে যখন অনেকেই আমেরিকার ধীরে বাদামি হয়ে যাওয়াকে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য থেকে মুক্তির লক্ষণ হিসেবে উদযাপন করছেন, নিশ্চিত করে বলা যায় বিরাটসংখ্যক শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান, নিজেরা স্বীকার করুক বা না করুক, ব্যাপারটা নিয়ে যারপরনাই উদ্বিগ্ন।’

দেখা যাচ্ছে, কোনো আধিপত্যবাদী গোষ্ঠীর আধিপত্য অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়লে তারা গোষ্ঠী পরিচয় আঁকড়ে ধরে জাতীয়তাবাদকে উসকে দেয় ও ক্ষুদে গোষ্ঠী পরিচয়কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে জোট বাঁধে। এরা যেকোনো প্রকারে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে। এরপর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে পূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে ভেতর থেকে কুরে খেতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি সম্পর্কে যোশেফ ই স্টিগলিৎজ লিখেছেন, ‘এই শতাব্দীতে নির্বাচিত তিনজন প্রেসিডেন্টের মধ্যে দুজনই ক্ষমতায় এসেছেন মোট ভোট কম পেয়ে বা জনপ্রিয়তায় পিছিয়ে থেকে। কম জনসংখ্যা অধ্যুষিত প্রদেশগুলোর স্বার্থে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত ইলেক্টোরাল কলেজের কারসাজিটা না থাকলে আল গোর ২০০০-এ ও হিলারি ক্লিনটন ২০১৬-তে প্রেসিডেন্ট হতেন (আমেরিকায় গণতন্ত্র ফিরে আসতে পারে? প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, নভেম্বর ৬, ২০১৮)। স্টিগলিৎজ আরো লিখেছেন যে, গোষ্ঠীবাদী পরিচয় উসকে দিয়ে ও গোষ্ঠীতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে গণতন্ত্রকে কুরে খাওয়া কেবল মার্কিন সমস্যা নয়। লিখেছেন, সারা বিশ্বে শক্তিমান লোকেরা গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে ক্ষমতা দখল করছে। তুরস্কে রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান, হাঙ্গেরিতে ভিক্টর অরবান, পোল্যান্ডে জারোস্লো কাজিনস্কি ও এখন ব্রাজিলে জায়ের বোলসোনারো।

ইউরোপ এখন ভাঙনের মুখে আর এ সময় গোষ্ঠীতন্ত্রের ছোঁয়াচে রোগও সেখানে বিস্তার লাভ করছে। আনা পালাশিও লিখেছেন, ‘জাতীয়তাবাদী শক্তিসমূহের ক্রমবর্ধিষ্ণু হারে সংগঠিত হওয়ার প্রক্রিয়া যা ইউরোপিয়ান ঐক্য প্রক্রিয়া ও এমনকি ইউরোপিয়ান মূল্যবোধের বিরোধি তা জোরদার হচ্ছে। এসব শক্তির মধ্যে আছে হাঙ্গেরির ফিডেসজ, পোল্যান্ডের ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি, জার্মানির অলটারনেটিভ ফর ডয়েসল্যান্ড, সুইডিশ ডেমোক্র্যাটস, ইতালির লীগ, ফ্রান্সে মেরিন লা পেনের ন্যাশনাল পার্টি (পূর্বের ন্যাশনাল ফ্রন্ট) এবং গির্ট উইল্ডার্সের ডাচ ফ্রিডম পার্টি। (প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮)। আমাদের আশপাশেও গোষ্ঠীতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদের পালে হাওয়া লেগেছে। ভারতে মুসলিমবিদ্বেষকে ক্ষমতায় আসার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে একটি ধর্মান্ধ দল সফল হয়েছে। মিয়ানমারে চলছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা, নির্যাতন ও উচ্ছেদ। সেখানে একটি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে গণহত্যার মাধ্যমে সম্পূর্ণ নির্মূল করার নীলনকশা বাস্তবায়ন চলছে গোষ্ঠীতান্ত্রিক ধর্মীয় উগ্রতার অস্ত্র ব্যবহার করে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসার অনেক আগে থেকেই এসবের চর্চা চলছে। ট্রাম্প এসে সে চর্চায় কেবল রকেটের গতি সঞ্চার করেছেন।

গোষ্ঠীতান্ত্রিক মনোভাব মানব চরিত্রের অংশ। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় এ ধারণা আরো বদ্ধমূল হচ্ছে। ড্যানিয়েল ইয়ুডকিন এ ব্যাপারে গার্ডিয়ান পত্রিকায় (হাউ পলিটিক্যাল ট্রাইবালিজম ক্যান বি এক্সপ্লেইনড ইউজিং সোশ্যাল সায়েন্স, ২৭ মার্চ ২০১৮) লিখেছেন, ‘মানব বিবর্তনের সঙ্গে পরিচিত কারো কাছে এটা আশ্চর্যের নয় যে, মানুষ চরিত্রগতভাবে গোষ্ঠীবাদী। হোমো সেপিয়েন্স তার বিবর্তনের ইতিহাসের একটা বড় সময় ব্যয় করেছে আফ্রিকার তৃণভূমিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে বেঁচে থাকার সামান্য উপকরণের জন্য একে অপরের সঙ্গে লড়াই করে। ফলে গোষ্ঠী-সংঘর্ষ আমাদের ডিএনএতে লেখা।’ তবে বড় সত্য হলো, ডিএনএতে লেখা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীপ্রবণতাকে অতিক্রম করেই মানুষ তার অগ্রগতি সম্ভব করেছে। মানুষ ক্ষুদ্র পরিচয় ত্যাগ করে বড় পরিচয় ধারণের চেষ্টা করে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী বৃহৎ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়। মানুষ এভাবে গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে হানাহানি ও যুদ্ধবিগ্রহ রোধ করে প্রগতির পথযাত্রী হয়। এই বৃহৎ গোষ্ঠীকে কিন্তু আর গোষ্ঠী পরিচয়ে সীমায়িত করা যায় না। রাষ্ট্র এমন একটি বৃহৎ পরিচয় যেখানে গোষ্ঠীবাদিতা প্রকট হলে রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যের জন্য তা ভয়ানক ক্ষতিকারক হয়। আর আধুনিক রাষ্ট্র কেবল গোষ্ঠী স্বার্থ উদ্ধারের জন্য নয়। ইতোমধ্যে যেসব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সর্বস্বীকৃত হয়ে উঠেছে প্রতিটি রাষ্ট্রকে তা মানতে হয়। সর্বোপরি প্রতিটি রাষ্ট্র কেবল তার নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জংলি লড়াইয়ে মেতে উঠতে পারে না, তাদের পৃথিবীর সবার স্বার্থরক্ষার কথাও ভাবতে হয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট, বৈশ্বিক উষ্ণতা, পারমাণবিক আক্রমণ, দুরারোগ্য ব্যাধি ইত্যাদি কোনো গোষ্ঠীতান্ত্রিক সমস্যা নয়, বৈশ্বিক সংকটÑ যার সমাধান আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি দাবি করে।

গোষ্ঠীতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদকে উসকে দিয়ে এখন তাই কেবল পেছনে ফিরে যাওয়া যায়, সামনে এগোনো যাবে না। ট্রাম্পরা ভবিষ্যতকে ভয় পাচ্ছে। তারা তাই পেছনে ফিরে যেতে চেষ্টা করছে। পৃথিবীকে তারা জংলি গোষ্ঠীতান্ত্রিক হানাহানির যুগে ফিরিয়ে নিতে চায়। তারা তাই গোষ্ঠীতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদের বৈশ্বিক সংস্থা খুলেছে। কিন্তু মানবসভ্যতাকে বাঁচাতে হলে এই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের ট্রাম্পরোগ দূর করে বিশ্বের সবাইকে একই পরিবারের সদস্য ভাবার আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের বিকল্প নেই।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, শিক্ষালোক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close