সেলিম আহমেদ

  ২৮ অক্টোবর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়

পরিবারে অশান্তি, পরীক্ষায় ফল বিপর্যয়, প্রেমে ব্যর্থতা, জীবন নিয়ে হতাশা, ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার কিংবা অন্য কোনো কারণ! এসব হতাশা থেকে সিদ্ধান্ত নিলে পৃথিবীর প্রতি আর কোনো মায়া থাকে না। চলে যাবেন...? হ্যাঁ, সিদ্ধান্ত আপনার। বিষপান, ছাদ থেকে ঝাঁপ, গলায় ফাঁস অথবা গাড়ির নিচের পড়ে আত্মহত্যা করে মারা গেলেন। পুলিশ লাশ উদ্ধার করল, ময়নাতদন্ত হলো, সমাহিত অথবা শেষকৃত্য হলো। একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। কিন্তু না; এখানেই শেষ নয়। কখনো কি চিন্তা করে দেখেছেন আপনার পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তান অথবা আত্মীয়স্বজনের কথা। আপনি আত্মহত্যা করার পর কী হবে তাদের। আত্মহত্যা করার পর আপনার স্বজনরা কীভাবে মুখ দেখাবে সমাজে। আত্মহত্যা করলেই কি সব কিছুর সমাধান হয়ে যাবে। না, হবে না। তাই আত্মহত্যা করার আগে একবার চিন্তা করুন এই পৃথিবীতে মানুষ একবার জন্মগ্রহণ করে। জীবনে চলার পথে বাধাবিপত্তি আসবেই। এসব রুখে দাঁড়ানোর নামই হচ্ছে মানবজীবন।

বাংলাদেশে বর্তমানে শিশু-কিশোরদের মাঝে আত্মহত্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। গত কয়েক বছরের জরিপে সেই ভয়ংকর তথ্য এসেছে। শিশু অধিকার ফোরাম বলছে, ২০১২ থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মোট ৯৭০ জন শিশু আত্মহত্যা করেছে। ২০১৭ সালে ২১৩ শিশু আত্মহত্যা করে, যা ২০১৬ সালে ছিল ১৪৯। চলতি বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের প্রথম চার মাসে ১১০ শিশুর আত্মহত্যা করার তথ্য এসেছে মিডিয়ায়। এ আত্মহত্যার কারণ হিসেবে মা-বাবার সন্তানের প্রতি অতি উচ্চাকাক্সক্ষাকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের ৩০ কোটিরও বেশি মানুষ বিষণœতায় ভুগছে। আর বাংলাদেশে বিষণœতায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৬ শতাংশ অর্থাৎ ৭৪ লাখেরও বেশি। গত ১০ বছরে বিশ্বব্যাপী এ রোগের ব্যাপকতা বেড়েছে ১৮ শতাংশ। শুধু বিষণœতার কারণে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। শুধুমাত্র গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা গেছে, চলতি মাসের ১ থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশে আত্মহত্যা করেছেন ২০ জন। এর মধ্যে ১ অক্টোবর অভাবের তাড়ায় গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন রাজশাহী নগরীর উপকণ্ঠ কাটাখালি থানার মনসুর রহমান (৪৩) নামে এক প্রান্তিক কৃষক। ৩ অক্টোবর যৌতুকের জন্য শ্বশুরবাড়ির লোকজনের মানসিক নির্যাতন সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেন বরিশালের মুলাদী উপজেলার বাটামারা ইউনিয়নের চরবাটামারা গ্রামের গৃহবধূ ইসরাত জাহান ইতি। ৪ অক্টোবর সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলায় প্রেম করার অপরাধে হত্যার হুমকি ও অপহরণ মামলা দেওয়ায় আত্মহত্যা করেন কাবিল হোসেন নামে এক যুবক। ৬ অক্টোবর রাঙামাটি শহরের পুরাতন পুলিশ লাইন এলাকায় গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন হ্যাপি চৌধুরী পূজা (১৭) নামে এক কলেজছাত্রী। ৭ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় স্বামীর নির্যাতনের কথা বলতে বলতে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন নিপা (২০) নামের এক গৃহবধূ। এর আগেও তিনি দুবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। ৮ অক্টোবর ফেসবুকে আপত্তিকর ছবি ছড়িয়ে দেওয়ায় মানিকগঞ্জে দিশারী বিশ্বাস মিম নামে এক স্কুলছাত্রী আত্মহত্যা করে। ওইদিনই কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলায় সাত বছর বয়সী ছেলে মিরাজকে রেললাইনের পাশে দাঁড় করে রেখে কলকাতা থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন মরিয়ম (৪০) নামে এক গৃহবধূ। ১০ অক্টোবর সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় এমপিও শিটে নাম না আসায় লোকলজ্জার ভয়ে বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন বিধান চন্দ্র ঘোষ (৪২) নামের এক শিক্ষক। ওইদিনই সিরাজগঞ্জ শহরের রেলওয়ে কলোনির নিজ বাড়িতে একই ঘরে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন সুমি খাতুন (৪০) ও মালা খাতুন (১৪) নামের মা ও মেয়ে। ১৬ অক্টোবর রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার কুমেদপুর ইউনিয়নের বগেরবাড়ী গ্রামে সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্র জাকির হোসেন (২২)। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ১৬ অক্টোবর বরিশালের শোভন নগরীর বাজার রোড এলাকায় মোটরসাইকেল কিনে না দেওয়ায় মা-বাবার সঙ্গে অভিমান করে গলায় ফাঁস নিয়ে শোভন (১৩) নামে এক স্কুলছাত্র আত্মহত্যা করে। ১৯ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি বেসরকারি হাসপাতালের ছাদ থেকে চার দিনের নবজাতক সন্তানকে ছুড়ে ফেলে সীমা আক্তার (২৫) নামে এক গৃহবধূ আত্মহত্যা করেছেন। ১৯ অক্টোবর রাতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদ্দাম হোসেন হলের ২২৯নং কক্ষে গলায় ফাঁস নিয়ে নাজমুল হাসান নামের এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন নাজমুল। ২০ ও ২১ অক্টোবর পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলায় পৃথক স্থানে সুকদেব হাওলাদার (৩২) ও সুমন হাওলাদার (২৫) নামে দুই যুবক আত্মহত্যা করেন। ২১ অক্টোবর পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার মাদারবাড়ি গ্রামের প্রেমিকের মা বকাঝকা করায় এক কলেজছাত্রী আত্মহত্যা করেছেন। সে স্বরূপকাঠি সরকারি কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। ২২ অক্টোবর যশোরের সাংবাদিক দানিয়েল হাবিব নোভা (৪২) ওরফে নোভা খন্দকার আত্মহত্যা করেছেন। ২২ অক্টোবর সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার গোয়ালডাঙ্গা গ্রামে প্রতিবন্ধী মেয়ে তমালিকাকে (৮) বিষ খাইয়ে হত্যার পর মা শান্তি রানী মন্ডল (৩৪) একই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। প্রতিটি মৃত্যুর পেছনেই রয়েছে একটি জটিল কারণ। কিন্তু আত্মহত্যা না করে ধৈর্যসহকারে এসব সমাধান করা যেত।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ওই মায়ের কথাই যদি বলি, যিনি এত কষ্ট করে সন্তানকে গর্ভধারণ করলেন। সন্তান ভূমিষ্ঠ হলো; কিন্তু তাকে পৃথিবীর মুখ দেখতে দিলেন না। হাসপাতালের ছাদ থেকেই ছুড়ে ফেলে হত্যা করলেন। তারপর আত্মহত্যা করলেন নিজে। এতে কি সমাধান হলো?

রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার কুমেদপুর ইউনিয়নের বগেরবাড়ী গ্রামে সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যাকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্র জাকির হোসেন (২২)। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে যতটুকু জানা যায়, তিনি ছিলেন খুবই মেধাবী। অভাবের কারণেই তিনি অত্মহত্যা করেন। কিন্তু এটা কি ঘটার কথা ছিল। পরিবারের লোকজন খেয়ে না খেয়ে তাকে লেখাপড়া করালেন। স্বপ্ন দেখেন, লেখাপড়া করে চাকরি করে পরিবারের হাল ধরবেন তিনি। আলো ফেরাবে পরিবারে। তাকে নিয়ে কত স্বপ্ন। কিন্তু আত্মহত্যা করে সব স্বপ্ন ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন।

সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার গোয়ালডাঙ্গা গ্রামে প্রতিবন্ধী মেয়ে তমালিকাকে (৮) বিষ খাইয়ে হত্যার পর আত্মহননকারী মা শান্তি রানী মন্ডলের (৩৪) কথাইবা যদি বলা হয়! অভাবের পরিবার তার ওপর প্রতিবন্ধী মেয়ে তমালিকা বাড়ির আসবাবপত্র ভাঙচুর করত। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মেয়েকে হত্যার পর তিনি আত্মহত্যা করেছেন। এতে কি সমাধান হলো?

যশোরের সাংবাদিক দানিয়েল হাবিব নোভা (৪২) ওরফে নোভা খন্দকার অনেক ভালো মানের সাংবাদিক। অনেক প্রতিভা তার। কিন্তু এ সমাজ তার প্রতিভার কোনো মূল্যায়ন করেনি।

অভাবের তাড়নায় যশোর থেকে ঢাকায় এসেছেন

চাকরির জন্য। এক সাংবাদিক নেতার মাধ্যমে একটি অনলাইন পোর্টালে চাকরি পান তিনি। কিন্তু চাকরিটি বেশি দিন টেকেনি। অভাবের সংসারে নানা অশান্তি। এসব থেকে মুক্তি পেতেই হয়তো আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন তিনি। এতেও কি সমাধান হলো।

এভাবেই আত্মহত্যার তালিকায় যুক্ত হচ্ছে একের পর একটি নাম। কিন্তু যে কারণে তারা আত্মহতা করেছেন তার কি কোনো সমাধান হয়েছে। না তার কোনো সমাধান হয়নি। তবে আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়। জীবন চলার পথে অনেক বাধাবিপত্তি আর হতাশা গ্রাস করবেই। এসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। জীবন একবার। সুতরাং লড়াই এবং লড়াই। এখানে এই পৃথিবীতে এর কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close