তারাপদ আচার্য্য

  ১৯ অক্টোবর, ২০১৮

নিবন্ধ

দুর্গাপূজা : শক্তির আরাধনা

ব্রহ্মই আদ্যাশক্তি জগজ্জননী দেবী দুর্গা। বিশ্বব্রহ্মা-ে নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অত্যাচারিত জীবের দুর্গতি হরণ করার জন্য দেবী দুর্গার আবির্ভাব হয়। দেবতাদের সম্মিলিত তপস্যা ও জ্যোতি থেকে সৃষ্ট আদ্যাশক্তি মহামায়া দুর্গা নাম ধারণ করে মর্ত্যলোকে আগমন করেন। তান্ত্রিক সাধকরা দেবী দুর্গাকে মাতৃজাতির প্রতীক করুণাময়ী বলে তাকে নারীমূর্তিতে কল্পনা করেছেন। আদ্যাশক্তি মহামায়া জগজ্জননী দেবী দুর্গা কখনো ত্রিভুজা, কখনো অষ্টভুজা, আবার কখনো দশভুজা হিসেবে আবির্ভূত হন। সনাতন ধর্মমতে, বস্তুত যিনি ব্রহ্ম, তিনিই শক্তি। তিনিই দেবী দুর্গা। দুর্গা পূজা মূলত শক্তির আরাধনা। এর দর্শনটি হলো, দুর্বলের কোনো আত্মজ্ঞান হয় না, জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য চাই শক্তির সাধনা। আর ব্রহ্ম পরিপূর্ণতা লাভ করেন শক্তিতে। শক্তির পরিপূর্ণতার রূপায়ণ ঘটে জগৎসৃষ্টিতে।

সাধারণভাবে মনে করা হয়, অধুনা বাংলাদেশের তাহের পুরের রাজা কংসনারায়ণ নাকি প্রথম দুর্গা পূজা করেন। যদিও বাংলায় দুর্গোৎসব ইতিহাস যে কংসনারায়ণের সময়কাল থেকে শুরু হয় না, তা প্রায় হলপ করেই বলা যায়। কংসনারায়ণ দুর্গোৎসব করেছিলেন ষোড়শ শতাব্দীর শেষলগ্নে কিংবা সপ্তদশ শতাব্দীর সূচনায়। কিন্তু তারও আগেকার সাহিত্যে ও অন্যান্য সূত্রে বাংলায় দুর্গা পূজা উল্লেখ পাওয়া যায়। খুব সম্ভবত, যে বিপুল ব্যয়ে কংসনারায়ণ দুর্গোৎসব করেন, তাই সে যুগের জনমানসে দুর্গা পূজার সংজ্ঞা দিয়েছিল বদলে।

দুর্গা পূজা মূলত অনুষ্ঠিত হয় মার্কয়ে পুরাণের ভিত্তিতে; দেবী পুরাণ, কালিকা পুরাণ, বৃহৎ নন্দিকেশ্বর পুরাণ, দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী, দেবী ভাগবত প্রভৃতি গ্রন্থের ভিত্তিতে। এই গ্রন্থগুলো অনেক পুরনো। তার থেকে নির্বাচিত ৭০০ শ্লোক নিয়ে যে সংক্ষিপ্ত মার্কয়ে পুরাণ করা হয়েছিল তাকেই বলা হয় ‘দুর্গাশপ্তশতী’, কথ্য ভাষায় বলা হয় শ্রী শ্রী চ-ী। চ-ীর বর্ণনা অনুযায়ী, দুর্গম নামক অসুরকে বধ করায় মায়ের নাম হয়েছে দুর্গা। দুর্গম অসুরের কাজ ছিল জীবকে দুর্গতিতে ফেলা। দুর্গমকে বধ করে যিনি স্বর্গ বিতাড়িত দেবগণকে হৃতরাজ্য ফিরিয়ে দেন এবং জীবজগতকে দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা করেন তিনি মা দুর্গা। এ ছাড়া মহিষামর্দিনী, শূলিনী, পার্বতী, কালিকা, ভারতী, অম্বিকা, গিরিজা, বৈষ্ণবী, কৌমারি, বাহারী, চ-ী, লক্ষ্মী, উমা, হৈমবতী, কমলা, শিবাণী, যোগনিদ্রা প্রভৃতি নামে ও রূপে মায়ের পূজা হয়ে থাকে।

দুর্গা পূজা মাতৃরূপে, পিতৃরূপে, শক্তিরূপে, শান্তিরূপে, বিদ্যারূপে আবির্ভূত এক মহাশক্তি। তিনি সম্মিলিত দেবশক্তির প্রতীক। অসুর অর্থাৎ অপশক্তি বিনাশে দেবতারা তাদের সম্মিলিত শক্তিতে সৃষ্টি করেন মহাশক্তি মহামায়া। পুরাণের মত অনুসারে, শিবের তেজে দেবীর মুখ, যমের তেজে কেশ, বিষ্ণুর তেজে বাহুসমূহ, চন্দ্র তেজে স্তনদ্বয়, ইন্দ্রের তেজে মধ্যভাগ, বরুণের দেজে জংঘা ও উরু, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব ও ব্রহ্মার তেজে পদযুগল।... মহাদেব দিলেন শূল, কৃষ্ণ দিলেন চক্র, শঙ্খ দিলেন বরুণ, অগ্নি দিলেন শক্তি...। (দ্র. হংসনারায়ণ, ১৯৮০ ও ১৭৫) এই হলো বিপদনাশিনী দেবীমাতা দুর্গা। দুর্গতি হতে ত্রাণ করেন বলেই দেবীর নাম হয়েছে দুর্গা।

ষষ্ঠীতে দেবী ষষ্ঠাদিকল্প অর্থাৎ আবাহন, বোধন, আমন্ত্রণ, অধিবাস প্রভৃতি অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। যষ্ঠীতে সন্ধ্যাকালে দেবীর বোধন হয়। শাস্ত্রমতে, দেবীর বোধন হয় বিল্ববৃক্ষে বা বিল্বশাখায়। সপ্তমী থেকে নবমী পযর্ন্ত প্রতিমায় দেবীর অর্চনা করা হয়ে থাকে। সপ্তমীতে অন্যতম অনুষ্ঠান নবপত্রিকা প্রবেশ কদলীবৃক্ষসহ আটটি উদ্ভিদ এবং জোড়াবেল একসঙ্গে বেঁধে শাড়ি পরিয়ে বধুর আকৃতির মতো তৈরি করে দেবীর পাশে স্থাপন করা হয়। প্রচলিত ভাষায় একে কলাবউ বলে। অষ্টমীতে বিশেষ অনুষ্ঠান অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিতে আটচল্লিশ মিনিটে দেবীর বিশেষ পূজা ‘সন্ধিপূজা’। অষ্টমী তিথিতে কোনো কুমারী বালিকাকে পূজা করা হয়। নবমীতে হোমযজ্ঞের দ্বারা পূজার পুণ্যাহৃতি দেওয়ার রীতি। দশমী তিথিতে হয় দেবীর বিসর্জন। এই দশমী তিথি বিজয়াদশমী নামে খ্যাতে। রামায়ণ থেকে জানা যায়, পিতার আদেশ পালন করার জন্য রাজা দশরথের জ্যেষ্টপুত্র শ্রী রামচন্দ্র স্ত্রী সীতা ও অনুগত ভাই লক্ষণকে নিয়ে পঞ্চবটী বনে যান। রাক্ষসরাজ রাবণের বোন সুপর্নখা শ্রী রামচন্দ্রের রূপে মুগ্ধ হয়ে তার ভালোবাসা চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়। সুপর্নখা শ্রী রামচন্দ্রের ক্ষতি করতে গেলে শ্রী রামচন্দ্র তার নাক-কান তীর-ধনুক দিয়ে কেটে দেন। বোনের অপমানের প্রতিশোধ নিতে দুর্মতি রাবণ ছদ্মবেশে সীতাকে চুরি করে আটকে রাখেন অশোক কাননে। শ্রী রাম চন্দ্র সীতাকে উদ্ধার করার জন্য শক্তিদায়িনী দেবী দুর্গার পূজা করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রয়োজনীয় সবকিছু জোগাড় করে শ্রীরামচন্দ্র পূজা করত বসেন। একে একে অঞ্জলি দেওয়ার সময় ১০৮টা নীলপদ্মের জায়গায় একশ সাতটা নীলপদ্ম পান। আরেকটা নীলপদ্ম না পেলে পূজা থেকে যাবে অসম্পন্ন। সীতা উদ্ধারও হবে না। তাই তো নিরুপায় শ্রী রামচন্দ্র নিজের চোখ দিয়ে পূজা সম্পন্ন করতে উদ্যত হন। কেননা, শ্রী রামচন্দ্রের চোখ পদ্মের মতো ছিল বলে তার আরেক নাম ছিল পদ্মলোচন। মা দুর্গা শ্রী রামচন্দ্রের ভক্তিতে খুশি হয়ে চোখ তুলতে বাধা দিয়ে আশীর্বাদ করেন। দেবী দুর্গার আশীর্বাদে শ্রী রামচন্দ্র রাক্ষসরাজ রাবণকে পরাজিত করে সীতাকে উদ্ধার করলেন। সেই থেকে শরৎকালে হয়ে আসছে দুর্গা পূজা।

পৃথিবীতে শুভ-অশুভর যুদ্ধ চলছে প্রতিনিয়ত। সাধনার মহাযুদ্ধে জয়ী হতে পারলেই মানুষ মহাশক্তি দুর্গার সন্ধান পান। সাধনার দশম স্তরে উন্নীত হতে পারলেই পরমবিদ্যা মহাশক্তির নাগাল পাওয়া যায়। মানুষের এ স্তরে আসতে পারলেই অপরাজিত হন অন্তরাত্মার যুদ্ধে। এ যেন দশমীর মহাদশা যা মানুষ কখনো ভুলতে পারে না। পরাশক্তির অধিকারী অসুরকে বধ করার জন্য মা দুর্গা দশ হাতে দশ অস্ত্রে সুসজ্জিত তার দশ হাত দশ দিক রক্ষার প্রতীক। তার পায়ের নিচে আছে উদ্ধত সিংহ আর উদ্ধত অসুর। সিংহ রাজসিক আর অসুর তামসিক শক্তির প্রতীক। পশুরাজ সিংহ সাত্ত্বিক শুণাশ্রয়ী দেবীকে বহন করে। দেবী কাঠামোতে শোভা পায় দেব সেনাপতি কার্তিক যিনি শক্তির প্রতিক। সিদ্ধিদাতা গণপতি গণেশ, বিদ্যাদায়িনী সর্বশুক্লা সরস্বতী ও প্রভূত ঐশ্বর্যময়ী শ্রী দেবী লক্ষ্মী। কিন্তু সবার ওপরে শোভা পান মঙ্গলের বার্তাবাহী দেবাদিদেব মহাদেব। সবাই দেবীর এক এক শক্তির প্রতীক। মূলে কিন্তু তিনি এক পরমাবিদ্যা স্বরূপিনী, যিনি সর্বভুতের প্রাণরূপী মহা দিব্য মূর্তি মা ও জগৎ মঙ্গলময়ী দুর্গা। দেব সেনাপতির পাশে দাঁড়িয়ে আছেন নব বা কলাবৌ। সর্বজীবের প্রাণরক্ষার উপযোগী শাকগুলোর দ্বারা পৃথিবীকে পালনকারিণী দেবীর নাম সার্থক করার মানসেই দুর্গা পূজার নবপত্রিকা রচনার বিধান রয়েছে। কারণ দেবীর আর এক নাম শাকম্ভরী।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক

সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close