ইফতেখার আহমেদ টিপ

  ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

মতামত

মরণঘাতী বায়ুদূষণ

বায়ুদূষণে মানুষ শুধু নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে না, অকাতরে জীবনও হারাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে বায়ুদূষণের কারণে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকাতেই মারা গেছে ১৮ হাজার। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু পরিবেশ দূষণের ফলে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের ২৭ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। পরিবেশ দূষণজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যুর দিক দিয়ে বাংলাদেশের পরই আছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। ২০১৫ সালের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রণীত প্রতিবেদনে ভারতে এ হার ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ। নেপালে মারা যায় ২৫ দশমিক ৮ শতাংশ, পাকিস্তানে ২২ দশমিক ২ শতাংশ, আফগানিস্তানে ২০ দশমিক ৬ শতাংশ ও ভুটানে ১৩ শতাংশ। এদিক থেকে সবচেয়ে কম মানুষ মারা যায় মালদ্বীপে।

এ দেশটিতে বায়ুদূষণজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ১১ দশমিক ৫ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বায়ুদূষণজনিত কারণে মৃত্যুর যে সংখ্যা তুলে ধরা হয়েছে, তা আঁতকে ওঠার মতো। বায়ুদূষণ যে দীর্ঘস্থায়ী নানা রোগ ও অসুস্থতার কারণÑ তা জানা থাকলেও এটি মানুষের জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেওয়ার বিষয়টি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে স্পষ্ট করা হয়েছে। সন্দেহ নেই, বায়ুদূষণ এক বিশ্বজনীন সমস্যা।

আমাদের গ্রহের অধিবাসীদের স্বাস্থ্যের জন্য তা হুমকি হয়েও দাঁড়িয়েছে। বায়ুদূষণের ফলে যেসব রোগে মানুষের অকালমৃত্যু ঘটছে, তার মধ্যে রয়েছে তীব্র শাসকষ্টজনিত রোগ, ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী রোগ, ফুসফুস ক্যানসার, হৃদরোগ ও স্ট্রোক। বায়ুদূষণ ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে আমাদেরই ভুলে। বিশেষত, দেশের নগর এলাকাগুলো মৃত্যুকূপে পরিণত হচ্ছে বায়ুদূষণের কারণে। অথচ, একটু সতর্ক হলেই বায়ুদূষণ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টিতে যেমন উদ্যোগ নিতে হবে, তেমনি যেসব কারণে বায়ুদূষণ ঘটছেÑতা রোধে প্রশাসনকে কঠোর মনোভাব দেখাতে হবে।

পরিবেশবিদদের মতে, ঢাকার চারপাশে থাকা ইটভাটা ও শিল্প-কলকারখানা এবং পুরনো মোটরগাড়ি থেকে নির্গত বিষাক্ত কালো ধোঁয়া এবং যত্রতত্র খোলা ডাস্টবিন বায়ুদূষণের মাত্রা বৃদ্ধি করছে। ধূলিময় ঢাকায় এখন প্রাণভরে শ্বাস নেওয়াই সম্ভব হয় না। বায়ুদূষণের কারণে পথচারীদের ব্যবহার করতে হচ্ছে মাস্ক। বায়ুদূষণের অশুভ প্রতিক্রিয়ায় মানুষ প্রতিনিয়ত শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, ফুসফুস ক্যানসার ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। জনসংখ্যার চাপে যানবাহন বৃদ্ধি পাওয়ায় গত কয়েক বছরে ঢাকার বায়ুদূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ঢাকার পানি এখন ভয়াবহ দূষণের শিকার। নদী ও প্রাকৃতিক জলাশয়ে শিল্পবর্জ্য ফেলার পরিণতিতে তা ব্যবহারের অযোগ্য। মাটি দূষণেও এটি অবদান রাখছে। বায়ুদূষণের বিষাক্ত ছোবল পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলছে।

বিশ্বব্যাংক ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এক যৌথ গবেষণা প্রতিবেদন মতে, ঢাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি। বর্তমানে সিসাযুক্ত পেট্রল আমদানি ও দুই স্ট্রোক ইঞ্জিনবিশিষ্ট বেবিট্যাক্সি চলাচল বন্ধ করার পরও বায়ুদূষণ প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। ফিটনেস ও কালো ধোঁয়ার সহনীয় মাত্রা পরীক্ষা ছাড়াই ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিন ঢুকছে বহু ট্রাক। এসব যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া বাতাসকে বিষিয়ে তুলছে। বিশেষ করে ঢাকার পাশেই নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, সাভার, ধামরাই, টঙ্গী, যাত্রাবাড়ী, লালবাগ ও হাজারীবাগে শিল্প-কারখানা অবস্থানের কারণে আশঙ্কাজনক হারে বায়ুদূষণ হচ্ছে। বায়ুদূষণ রাজধানীর দেড় কোটি মানুষের অস্তিত্বের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। নিজেদের স্বার্থেই এ বিপদ মোকাবিলায় ত্বরিত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এ ব্যাপারে সরকার ও পরিবেশ সংগঠনই শুধু নয়, নাগরিকদেরও উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

ত্রুটিপূর্ণ বাস, রিকন্ডিশন্ড গাড়ি, বেবিট্যাক্সি এবং বিভিন্ন কারখানা থেকে কালো ধোঁয়া ও বিষাক্ত রাসায়নিক বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। এখান থেকে মিথেন, ইথেলিন বাতাসে মিশ্রিত হয়ে প্রাণিদেহে প্রবেশ করছে। তাছাড়া চামড়াশিল্প, রং কারখানা, রাসায়নিক গবেষণাগার, পয়োশোধনাগার থেকে উৎপন্ন হাইড্রোজেন সালফাইডের সবই জীবজগতের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কঠিন বর্জ্য-আবর্জনা পোড়ানোর ফলে বাতাসে মিশে যাওয়া কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে এসবেস্টস আঁশ, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট নির্মাণ থেকে ধুলাবালি, সিগারেটের ধোঁয়া ও কীটনাশক স্প্রের কণা প্রতিনিয়ত বাতাসকে দূষিত করে মানবদেহে ক্যানসারসহ অ্যালার্জিজনিত নানা জটিল রোগের সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। বাড়ছে রোগ-ব্যাধি। রাজধানীর এক-চতুর্থাংশ শিশুর ফুসফুসের সক্ষমতা দ্রুত কমছে। দীর্ঘ মেয়াদে ধুলার মধ্যে থাকার কারণে অ্যাজমা, সিওপিডি, ব্রঙ্কাইটিস, শ্বাসনালি সংক্রান্ত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে পরিবার এমনকি রাষ্ট্রও।

তাই এই সমস্যা সমাধানে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পরিবেশ অধিদফতরের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। শুধু সরকারি উদ্যোগই নয়, প্রয়োজন এর সঙ্গে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে যুক্ত করে দেশের মানুষকে আরো বেশি সচেতন করে তোলা। বৃক্ষনিধন বন্ধ করে দেশব্যাপী বনায়ন কর্মসূচিকে উৎসাহিত করতে হবে। সেই সঙ্গে দূষণমুক্ত জ্বালানি ব্যবহারে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে। ইটভাটাগুলো দ্রুত আধুনিকায়ন করতে হবে। নির্মাণকাজে যাতে ধুলা কম হয়, সে বিষয়ে তদারকি বাড়াতে হবে।

লেখক : চেয়ারম্যান, ইফাদ গ্রুপ

Email: [email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close