আবুল বাশার শেখ

  ৩১ জুলাই, ২০১৮

মতামত

নারী ও শিশুকন্যা নির্যাতন

আমাদের দেশে দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে নারী ও শিশু নির্যাতন। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ধর্ষণের ঘটনাও। গত পাঁচ বছরে প্রতিদিন গড়ে আটজন শিশু এবং তিনজন নারী সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এই ভয়াবহতা দিন দিন শুধু বেড়েই চলছে। প্রতিরোধ করার সঠিক কার্যকর কোনো রাস্তা এখনো আবিষ্কার করতে পারেনি এই দেশের নারীবাদী কিংবা নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধকারী সংগঠনগুলোর কেউই। তাই নারী ও শিশুর প্রতি এই নির্মমতা ও ন্যক্কারজনক নির্যাতনের চিত্র ভারী হতে দেখেও নিরূপায় হয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে তথাকথিত বুদ্ধিজীবী বিবেকবান মানুষ। এ অবস্থায় জোরালো কোনো পদক্ষেপ তারা নিচ্ছে না বলেই এখন প্রতীয়মান হয়। তার পরও কিছু বিবেকবানের বিবেক নীরবেই ধিক্কার জানায় এসব কর্মকা-কে। আমাদের এ দেশের সমাজব্যবস্থা বর্তমানে প্রকৃতপক্ষে কোনদিকে যাচ্ছে, তা সত্যিই ভাবনার বিষয়। এ সমাজ নিয়ে কতজন চিন্তাশীল কাজ করছেন, তারও একটা সমীক্ষা দরকার।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে ২ হাজার ৬৩ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৯২টি। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার ৯৮ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৯ জনকে। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৬১ জনকে। সম্প্রতি মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. মালেকাবানু এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। পরিষদের লিগ্যালএইড উপপরিষদে সংরক্ষিত ১৪টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। মহিলা পরিষদ মনে করে, নারী নির্যাতনের সব ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশ করা হয় না। তাই প্রকৃত নারী নির্যাতনের ঘটনা আরো বেশি।

প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, ওই সময়ে ২৩ নারী শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন। যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৬৫ জন নারী ও কন্যাশিশু। ওই সময়ে অ্যাসিডদগ্ধ হয়েছেন ১০ নারী। এর মধ্যে অ্যাসিডদগ্ধের কারণে মৃত্যু হয় দুজনের। অগ্নিদগ্ধের ঘটনা ঘটেছে ৪৫টি। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১০ নারীর। একই সময় অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ৭৭টি। ১৩ নারী ও শিশু পাচার করা হয়েছে। এর মধ্যে পতিতালয়ে বিক্রি করা হয়েছে চারজনকে। ওই সময় বিভিন্ন কারণে ২৬৮ নারী ও কন্যাশিশুকে হত্যা করা হয়েছে এবং আরো ২৭ জনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। গত ছয় মাসে ১৩ গৃহপরিচারিকাকে নির্যাতন করা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা করা হয়েছে তিনজনকে এবং নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন দুজন গৃহপরিচারিকা।

একই সময় যৌতুকের জন্য হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১১৩ নারী ও কন্যাশিশু। এর মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ৫১ জনকে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, এ সময় উত্ত্যক্ত করা হয়েছে ৯০ নারী ও কন্যাকে। এর মধ্যে উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে ১১ জন। বিভিন্ন নির্যাতনের কারণে ১৫৪ জন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে। আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে ৯ নারী ও কন্যাশিশু এবং আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়া হয় ১৫ জনকে। ওই সময় ১৮৮ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ৮৪ কিশোরী। শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে ১৭১ জনকে। একই সময় বেআইনি ফতোয়ার ঘটনা ঘটেছে সাতটি। পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে তিনজন। ২০ জনকে জোর করে বিয়ের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া এ সময় ৬৮টি অন্যান্য নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এ চিত্র কতটা ভয়াবহ একটি দেশের জন্য, সেটা অন্তত একবার হলেও আমাদের ভাবা উচিত।

একটু বিশ্লেষণমূলক দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যাবে, আমাদের দেশে ন্যায্য বিচার না পাওয়ার কারণে নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ধর্ষণ বেড়েই চলছে। সামাজিক অবক্ষয়, পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কুশিক্ষা নারী নির্যাতনের নেপথ্যের বড় কারণ। আইনের দিক বিবেচনা করলে দ্রুত বিচার না হওয়াকে এ ক্ষেত্রে দায়ী করা যেতে পারে। এ দেশের নারী ও শিশু নির্যাতনের চিত্র এমন একটি অবস্থায় বিরাজ করছে, চোখের সামনে নারী ও শিশু নির্যাতন হলেও কেউই তেমনভাবে এগিয়ে আসছে না। কোনো নারী যদি তার ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে, তাহলে সমাজপতিরা তাকে নানাভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন।

সামাজিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের অভাব ও সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে নারী নির্যাতনের ঘটনা আশঙ্কাজনক বাড়ছে। স্কুল, কলেজ, কোচিং, এমনকি নিজ বাড়িতেও নিরাপদ নয় নারী ও শিশু-কিশোরীরা। নির্যাতনের ঘটনায় ভয়ে মামলা না করা, ত্রুটিপূর্ণ তদন্ত, বিচারে দীর্ঘ প্রক্রিয়া, সামাজিক ও প্রশাসনের নির্লিপ্ততাসহ নানা কারণে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ বন্ধ হচ্ছে না।

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই রাতারাতি এর পরিবর্তন সম্ভব নয়। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদের সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নারীদের সাহস করে প্রতিবাদ করতে হবে। সঠিক আইনের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে হবে। সরকারের সার্বিক সহযোগিতা নিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে নাগরিক সচেতনতার মাত্রাবৃদ্ধি করতে হবে। পরিবার থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন, উচ্চ বিদ্যালয় এমনকি কলেজ বা মহাবিদ্যালয়গুলোকে এই সচেতনতা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে প্রতিটি পরিবারকে যুক্ত হতে হবে। এ ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদ বা ওয়ার্ড কাউন্সিল একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তারা এই সচেতনার বার্তাটি অতি দ্রুত জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারবেন। সাধারণত, কর্মজীবী শিশুরা অধিক নির্যাতনের শিকার হয় বলে বাজারে বাজারে গিয়ে ব্যবসায়ীদের সচেতন করতে হবে। অন্যদিকে সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন ও সিনেমাকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে বিভিন্ন সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রকাশ ও প্রচার করা যেতে পারে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist