নিতাই চন্দ্র রায়

  ২৫ জুন, ২০১৮

নিবন্ধ

গ্রামীণ অর্থনীতিতে মৌসুমি ফল

দানাশস্য, শাকসবজি, তেলবীজ ও মসলাজাতীয় ফসলের তুলনায় বেশি লাভজনক হওয়াতে দেশে প্রতি বছরই বাড়ছে ফলের চাষ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বৈশ্বিক কৃষি উৎপাদন প্রতিবেদন অনুয়ায়ী ২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে ফলের উৎপাদন ১১.৪ শতাংশ এবং হেক্টরপ্রতি ফলের উৎপাদন বেড়েছে ১০ শতাংশ। উৎপাদনের এই দুই দিকেই বাংলাদেশের ফল উৎপাদন বৃদ্ধির হার বিশ্বে সর্বোচ্চ। এফএওর ২০১৩ সালের বিপোর্ট অনুযায়ী ফল উৎপাদনের দিক দিয়ে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিল বিশ্বের পর্যায়ক্রমে শীর্ষ স্থানে রয়েছে। আর মোট ফল উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বে ২৮তম স্থানে বাংলাদেশের অবস্থান। বাংলাদেশ আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম ও পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে উঠে এসেছে।

খাদ্য, পুষ্টি, ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের প্রাকৃতিক উৎস হলো ফল। বিচিত্র বর্ণ, আকর্ষণীয় স্বাদ ও গন্ধের জন্য ফল মানুষের প্রিয় খাদ্য। মানুষের শারীরিক বৃদ্ধি, মেধার বিকাশ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং রফতানি আয় বৃদ্ধিতে মৌসুমি ফলের রয়েছে উল্লেখযোগ্য অবদান। কর্মসংস্থান, দারিদ্র্যবিমোচন ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে মৌসুমি ফলের ভূমিকাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সুস্থ থাকার জন্য একজন সাধারণ মানুষের প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম ফল খাওয়া উচিত। সে হিসেবে দেশে ফলের প্রয়োজন কমপক্ষে ১ কোটি ৪৬ লাখ টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে ৫৬ ধরনের ১ কোটি ১০ লাখ টন ফল উৎপাদিত হয়। এর আগের বছর দেশে ফলের উৎপাদন ছিল ১ কোাটি ৬ লাখ টন। দৈনিক গড়ে ১০০ থেকে ১৫০ গ্রাম করে ফল খাওয়ার মতো পর্যাপ্ত ফল দেশে উৎপাদিত হলেও পুষ্টি সম্পর্কে সচেতনতার অভাবে আমরা দৈনিক গড়ে ফল গ্রহণ করছি মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ গ্রাম। ফলে শুধু ভিটামিনের অভাবে জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে বাড়ছে ক্ষতিকর কীটনাশক ও রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে অসময়ে অপরিপক্ব ফল পাকানোর প্রবণতা। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ও বাগান মালিকের সীমাহীন লোভের কারণে ফলের মতো একটি পুষ্টিকর খাবার পরিণত হয়েছে বিষাক্ত বস্তুতে। ২০১২ সালে গাছতলা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া বিষাক্ত কীটনাশকমিশ্রিত লিচু খেয়ে দিনাজপুরে ১৪ শিশুর অকালমৃত্যু সারা দেশের মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলে এবং ফলের কথা শুনলে মানুষ ভীষণ ভয় পায়। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলেন, কেমিক্যালমিশ্রিত ফল খেলে মানুষের লিভার অকেজো হয়ে পড়তে পারে। প্র¯্রাবের সঙ্গে প্রোটিন যায়। দীর্ঘ মেয়াদে খেলে কিডনি নষ্ট হয়। নার্ভ, ব্রেন, ত্বক ও চোখে সমস্যা দেখা দেয়। কেমিক্যালের পরিমাণ বেশি হলে ফুসফুস ও ত্বকে ক্যানসারও হতে পারে।

পুলিশ ও র‌্যাবের অভিযানে কয়েক হাজার মণ আম ধ্বংসের পরিপ্রেক্ষিতে জনসচেতনতা তৈরির জন্য এ কর্মশালার আয়োজন করা হয়। কর্মশালায় বক্তারা বলেন, কার্বাইড প্রয়োগ করার সময় যিনি করবেন তার স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। তাই এটা দেশের আইনে নিষিদ্ধ। কিন্তু কার্বাইড ফলের ভেতর প্রবেশ করে না। অন্যদিকে ইথোফেন প্রয়োগ সারা বিশ্বে বৈধ। ফলের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত ইথোফেন থাকা বৈধ। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পরিচালক (পুষ্টি) মনিরুজ্জামানের মতে আমে ইথোফেন প্রয়োগ করা হলে সেটা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নির্ধারিত মাত্রার নিচে চলে আসে। এ ছাড়া ফরমালিন কোনোভাবেই ফল ও শাকসবজিতে কাজ করে না। এটা কাজ করে আমিষের ক্ষেত্রে। ২০১৪ সালে রাজধানীর পাঁচটি প্রবেশপথে ফরমালিনমিশ্রিত আম ধ্বংসের নামে যে তা-ব চালানো হয়, তাতে আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হন। তারপর জানা গেল যে যন্ত্রটি আমে ফরমালিন শনাক্তের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটি ছিল ত্রুটিপূর্ণ।

বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আমের বাম্পার ফলন হয়েছে। গরমের কারণে এবার তাপমাত্রা বেশি থাকায় সব ধরনের আম সময়ের আগেই পেকে গেছে। কিন্তু প্রশাসনিক বাধানিষেধ থাকায়, তা বাজারে তোলা সম্ভব হয়নি। এ কারণে অনেক আম পেকে নষ্ট হয়ে গেছে। আর একসঙ্গে বেশি আম বাজারে আসায় ও রোজার কারণে দাম অর্ধেকে নেমে এসেছে। গত বছর নওগাঁর সাপাহার বাজারে হিমসাগর আম প্রতি মণ বিক্রি হয়েছে ২০০০ থেকে ২৫০০ টাকা দরে, যা এবার বিক্রি হচ্ছে ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা দরে। গোপালভোগ গত বছর বিক্রি হয়েছে ১০০০ থেকে ১৬০০ টাকা মণ দরে, এ বছর বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা মণ দরে। ল্যাংড়া গত বছর প্রতি মণ বিক্রি হয়েছে ২০০০ থেকে ৩৫০০ টাকা দরে। এ বছর বিক্রি হচ্ছে ১০০০ থেকে ১৩০০ টাকা দরে। সাপাহার ছাড়াও রাজশাহীর বানেশ্বর, ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের হাট-বাজারে আম বিক্রি হচ্ছে গত বছরের অর্ধেক দামে। বর্তমানে ক্ষিরসাপাতি ও ল্যাংড়ার মতো সুস্বাদু আম প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা মণ দরে। এ দামে আম বিক্রি করে কৃষক উৎপাদন খরচও তুলতে পারছেন না। অনেকে আক্ষেপ করে বলেন, লাভের আশায় ধানখেত ধ্বংস করে আমের বাগান করা হয়েছিল। আমের দাম না বাড়লে আবার আমগাছ কেটে ধানের আবাদ করা ছাড়া কৃষকের আর কোনো উপায় থাকবে না। রাজশাহী অঞ্চলে প্রায় আট কোটি আমে ফ্রুটব্যাগিং করা হয়েছে এবার। এসব কীটনাশকমুক্ত আম বিদেশে রফতানি করা গেলে বেশি মূল্য সংযোজন হবে এবং কৃষকও আমের ন্যায্য মূল্য পাবেন।

উৎপাদিত লিচুর শতকরা ৭৫ ভাগই শেষ হয়ে গেছে। বাকি আছে ২৫ ভাগ লিচু। মৌসুমের শেষে বেশ চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে বোম্বাই ও চায়না-৩ জাতের লিচু। লিচুর রাজধাানী দিনাজপুরে এখন বোম্বাই ও চায়না থ্রি-৩ লিচুপ্রতি ১০০টি বিক্রি হচ্ছে যথাক্রমে ৩০০ ও ৬০০ টাকা দামে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, এ বছর জেলায় মোট ৫ হাজার ২৮১ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে। গত বছর আবাদ হয়েছিল ৫ হাজার ১৮৪ হেক্টর জমিতে। সেবার উৎপাদন হয় ২৪ হাজার ৬১২ টন। এবার

লিচুর ফলন গত বছরের চেয়ে বেশি হয়েছে।

বাংলাদেশে উৎপাদিত মোট ফলের শতকরা ১৯ ভাগ পাওয়া যায় মাঘ থেকে বৈশাখ মাসে, ৬০ ভাগ পাওয়া যায় জ্যৈষ্ঠ থেকে ভাদ্র মাসে এবং ২১ ভাগ পাওয়া যায় আশ্বিন থেকে পৌষ মাসে। বোরো ধান কাটার পর গ্রামাঞ্চলে কৃষিশ্রমিক ও কৃষকের তেমন কাজ থাকে না। এ সময় দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, পাবত্য অঞ্চলসহ সারা দেশের কৃষক আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, আনারস, জামরুল, লটকন, পেয়ারা, পেঁপে ও তরমুজের মতো মৌসুমি ফল পাড়া ও বাজারজাতকরণের কাজে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেন।

আমচাষি, ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা, এবার ১০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হবে। এতে সচল হয়ে উঠবে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা। কৃষি বিভাগের হিসাবে এবার দেশের বাইশ জেলায় ১ লাখ ৭৫ হাজার হেক্টর জমিতে হয়েছে আমের চাষ এবং উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে ২২ লাখ টন। বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আম উৎপাদিত হবে দেশে। মূল্যমান হিসেবে যা ১০ হাজার কোটি টাকা। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের আট-দশ লাখ মানুষ কয়েক মাসের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে আমসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফলের ব্যবসায়। বেপারি, কুলি, শ্রমিক, মজুর, ভ্যানচালক, ট্রাকচালক, কুরিয়ার পার্সেল ব্যবসায়ী, খাবার দোকান কর্মচারী, ঝুড়ি তৈরিকারক, আমপাড়া, প্যাকিং আর পরিবহন নিয়ে চলছে এদের ভীষণ ব্যস্ততা।

দেশে ফলের উৎপাদন বাড়লেও সেই তুলনায় বিদেশে রফতানি প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণশিল্পের সংখ্যা বাড়েনি। সংরক্ষণের অভাবে দেশে উৎপাদিত ফলের শতকরা ৩০ ভাগই নষ্ট হয়ে যায়। থাইল্যান্ডে উৎপাদিত ফলের শতকরা ৮০ ভাগই প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। এখানেই আমাদের ঘাটতি। এ ঘাটতি পূরণে বাংলাদেশকেও প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণশিল্পের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়াটা জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা মনে করি, সরকার নিশ্চয়ই এ ব্যপারে সক্রিয় ভূমিকাসহ এগিয়ে আসবে।

লেখক : কৃষিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist