মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম

  ২৭ এপ্রিল, ২০১৮

নিবন্ধ

হৃদয়ে রমজান প্রস্তুতি

আমাদের সামনে শবেবরাত। শাবান মাসের অর্ধেক প্রায় শেষের পথে। পবিত্র মাহে রমজানের বাকি আর মাত্র কয়েক দিন। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে মাহে রমজানের প্রস্তুতি। সারা বছরই এ মাসের অপেক্ষায় মুমিনদের হৃদয় অধির আগ্রহে থাকে। মহানবী (সা.) রজবের চাঁদ দেখেই দোয়া পড়তেন ‘হে আল্লাহ, আমাদের রজব ও শাবান মাসকে বরকতময় করে দাও এবং রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দাও।’ রাসূল (সা.) রমজানকে স্বাগত জানানের জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। মাহে রমজান যতই ঘনিয়ে আসতো রাসূল (সা.)-এর আমলের মাত্রা ততই বেড়ে যেত। হজরত সাহাবায়ে কেরামগণকে রমজানের পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিতেন। শবেবরাতের পর থেকে তাদের কাজকর্মে ও আমলে রমজানের আমেজ এসে যেত। মুমিন হৃদয়েকে খুশির জোয়ারে ভাসিয়ে দিতে পশ্চিম আকাশ লাল করে এক ফালি বাঁকা চাঁদ জানান দিয়ে আসছে মাহে রমজান। রোজা, তারাবি, সাহরি ও ইফতার আয়োজনের মধ্য দিয়ে এ মাস আত্মশুদ্ধির জন্য অপরিসীম। এ মাসে খুলে দেওয়া হয় রহমতের বারিধারা। বন্ধ করে রাখা হয় সব অনিষ্টতা। এ মাসকে কাজে লাগিয়ে ইচ্ছা করলে যেকোনো মুসলমান পারে নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে। আত্মাকে শান্তি দিতে। নবী করিম (সা.) ছিলেন নিষ্পাপ। তবু এ মাস পেতে তিনি প্রাণপণ দোয়া করতেন। দোয়া করতেন সাহাবীগণও। তাদের অন্তরে সবসময়ই এ ভয় কাজ করতÑ এতটুকু আমল জান্নাতে জন্য যথেষ্ঠ নয়। অন্তরে এ ভয় কাজ করত বলেই তারা দীর্ঘ রাত ব্যয় করে চোখের জলে ইবাদতে নিমগ্ন থাকতেন।

নবী এবং সাহাবীদের মতো এ ভয় থাকা চাই প্রতিটি মুসলমানের অন্তরে। পবিত্রতা, আত্মশুদ্ধি, উদার মানসিকতার মধ্যেই তো প্রকৃত শান্তি। অফুরন্ত এ শান্তি অর্জনে আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। রাসূল (সা.) আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান পাওয়ার পরও তার জীবনের গুনাহগুলো ক্ষমা করাতে পারল না, সে বড়ই দুর্ভাগা!’ রহমত মাগফিরাত ও নাজাতের এ মাস একজন মুমিনের কাক্সিক্ষত চাওয়া। একমাত্র মাহে রমজানই একজন মুমিনের চাওয়ার একমাত্র উপযুক্ত সময়। সুতরাং, মাহে রমজানকে হেলায়-খেলায় গতানুগতিক ধারায় কাটিয়ে দেওয়া সুস্থ বিবেকের কাজ নয়। আর রমজানের চাওয়া ও পাওয়ার সংযোজন ঘটাতে হলে প্রয়োজন পূর্ব পরিকল্পনা, যা এখন থেকেই করতে হবে। সারা বছরের পাপ অনিষ্টতা দূর করে নিজেকে সাফ করতে হবে এ মাসেই। তাই শুরু হোক আমাদের প্রস্তুতি।

যেকোনো কাজের জন্য প্রথমে প্রয়োজন মানসিক প্রস্তুতি। নিয়তে গরমিল থাকায় অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ কাজও পড়ে থাকে অবহেলায়। রোজার ক্ষেত্রেও এ প্রবণতা চোখে পড়ে। আবার দিনেরবেলায় খাবার সামনে দেখে আত্মলালসায় ভোগেন অনেকে। এ জন্য লোভ, অহংকার পরিত্যাগ করে মনোবল দৃঢ় করতে হবে। রাসূল (সা.) রজব মাস থেকেই রমজানের প্রতীক্ষায় থাকতেন। রমজান পর্যন্ত পৌঁছার জন্য দোয়া করতেন। সুতরাং, রমজানের বিভিন্ন দিক ও ফজিলত নিয়ে পারিবারিক তালিম তথা গুরুত্ব বোঝাতে হবে এবং মাহে রমজানের প্রতি আগ্রহী করতে হবে। রোজা রাখার পাশাপাশি কোরআন তেলাওয়াত বাড়িয়ে দিতে হবে। পরিবারের কেউ কোরআন তেলাওয়াত করতে না পারলে তাকে শেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। পরিবারের প্রতিটি সদস্যই যেন রমজানে অধিক পরিমাণে তেলাওয়াত করতে পারেন, সে প্রস্তুতি নিতে হবে। রমজানে যেন তাহাজ্জুদ আদায় করা যায়, সে প্রস্তুতি এখন থেকে প্রতি রাতে অন্তত দুই রাকাত তাহাজ্জুদ আদায় করা যেতে পারে। পরিবারের সবাইকে তাহাজ্জুদ নামাযের জন্য জাগিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কারণ, তখন অভ্যাস হয়ে গেলে রমজানে তা আদায় করতে সহজ হবে। রমজানের কাজকর্মের ভিড়ে পরিবারের নারী সদস্যরা যেন আমল করতে অপারগ না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে প্রত্যেক সদস্যকে পরিবারের বিভিন্ন কাজ ভাগাভাগি করে নিতে হবে। সবার কাজে সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে। এ ছাড়া রমজান পূর্ব সময়ে সামাজিক প্রস্তুতি হিসেবে প্রতিবেশী ও সমাজের মানুষদের অভিনন্দন জানাতে হবে। রাসুল (সা.) রমজান এর পূর্ব সময়ে সমাজের লোকদের রমজান আগমনের বার্তা দিতেন। মাহে রমজানের সুসংবাদ জানাতেন। আশপাশের সবাইকে রোজা রাখার ব্যাপারে উদ্ধুদ্ধ করা। রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় এ মাস আসার আগেই সামাজিকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রস্তুতি হিসাবে মাহে রমজানের সার্বিক চিন্তা করে অর্থনৈতিকভাবে ও পরিবারকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। রমজানের বাজার যেহেতু আমাদের দেশে একটু ভিন্ন রূপ ধারণ করে! তাই প্রয়োজনের অতিরিক্ত দ্রব্য ক্রয় থেকে বিরত থাকতে হবে। বাজারে বিরূপ প্রভাব যেন না পড়ে; সে লক্ষে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। অন্য দিকে রমজানের সাওয়াবের আশায় যেন কোনো ধরনের অপচয় না হয়, সেদিকে ও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। নিজেরা সচ্ছল হলে অর্থনৈতিক ভাবে অন্যকে সহযোগিতা করতে হবে। দানের হাত আরো বড় করতে হবে। রাসুল (সা.) রমজান মাসে প্রচুর পরিমাণে দান করতেন। জাকাত ফরজ হলে হিসাবটা আগেই করে নিতে হবে। রমজান আসার আগেই তার পরিপূর্ণ বরকত ও পূণ্য অর্জনে পরিবারকে মনোযোগী হতে হবে।

রমজান এলেই ব্যবসায়ীরা খুশিতে আত্মহারা হন। এ সুযোগে মুনাফা করে নেন বছরের দ্বিগুণ। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে বাড়তি ফায়দা লোটার ধান্দায় মত্ত থাকেন সব সময়। যে কারণে ভালো সব পণ্য থাকে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। এটি শুধুই অমানবিক নয়; রীতিমতো চরম অন্যায়। এ ব্যাপারে হাদিস শরীফে এসেছে কঠোর সর্তকতা। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘কেউ যদি কৃত্রিম উপায়ে খাদ্য গুদামজাত করে সংকট তৈরি করে, আল্লাহ্ তাকে কুষ্ঠ রোগ দেবেন কিংবা একদিন না একদিন তাকে অবশ্যই গরিব বানাবেন।’ অতএব ব্যবসায়ীদের এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিত। দাম বাড়ানোর কারণে যেন কোন রোজাদার কষ্ট না পান, নিজেরাও যাতে হালাল উপার্জনে রোজা পালন করেন সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সর্বোপরি মাহে রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করা সবার জন্যই কর্তব্য। সবারই খেয়াল রাখা কর্তব্য, নিজের কারণে যাতে কোনো রোজাদারের ক্ষতি না হয়। পবিত্রতা রক্ষার স্বার্থে রমজানে গান-বাজনা, সিনেমা, হোটেল এবং রোজাদারের জন্য ক্ষতিকর এমন সবকিছুই বন্ধ রাখা। পাশাপাশি অশ্লীল কথাবার্তা, শব্দদূষণ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা। সহজ, স্বাভাবিক এবং শান্তিপূর্ণ জীবন সবারই কার্ম্য। দীর্ঘ ১১ মাসের পাপাচারের কারণে অন্তরে যে কালিমা লেপন হয়েছে, তা দূর করতে হবে। কুপ্রবৃত্তির লাগাম টেনে ধরতে হবে। রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা, অগোচরে নিন্দা তথা পাপকার্য থেকে বিরত রইল না, তার রোজা অর্থহীন উপবাস ছাড়া আর কিছুই নয়।’ ভাবনাহীন জীবন আর বাড়তি আবেগপ্রবণতা মানুষের জন্য ক্ষতিকর। আসুন, আসন্ন মাহে রমজানকে স্বাগত জানিয়ে বরণ করি এবং এ সময়টাকে কাজে লাগাই। আত্মাহংকার ছেড়ে আত্মশুদ্ধির পথ গ্রহণ করি।

লেখক : কলামিস্ট ও সাংবাদিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist