মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ

  ২৩ মার্চ, ২০১৮

স্মরণ

দশজন উম্মাহাতুল মুমিনীন

মুহাদ্দিসিন ও ঐতিহাসিকরা এ বিষয়ে একমত যে, উম্মাহাতুল মুমিনিনের সংখ্যা ১১ জন। এর অধিক সংখ্যার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। কারো মতে রাসুল (সা.)-এর সর্বমোট স্ত্রী ছিল ১৩ জন। তবে একই সময়ে তার পতœীরূপে যারা ছিলেন, তাদের সর্বোচ্চ সংখ্যা হলো নয়জন।

১. হজরত খাদিজা বিনতে খুওয়ায়লিদ (রা.) : প্রাক ইসলামী যুগে হজরত খাদিজা (রা.) ‘তাহিরা’ নামে খ্যাত ছিলেন। তার প্রথম বিয়ে হয় তামীম গোত্রের আবু হালা হিন্দ ইবনে যুরারাহর সঙ্গে। এই ঘরে খাদিজা (রা.)-এর তিনটি সন্তান জন্মগ্রহণ করে। হিন্দ, হারিস এবং জায়নাব নামক এক কন্যা। এ স্বামীর মৃত্যুর পর তার দ্বিতীয় বিয়ে হয় মাখজুম গোত্রের আতীক ইবনে আইজের সঙ্গে। তার ঔরসে হজরত (রা.)-এর গর্ভে এক কন্যা জন্ম লাভ করে। কিছুকাল অতিবাহিত হওয়ার পর আতিক ইবনে আইজও মৃত্যুবরণ করেন। বিধবা ধনবতী খাদিজা (রা.) মক্কার ‘আল-আমিন’ নামে খ্যাত মুহাম্মদ (সা.)-এর কর্তব্যনিষ্ঠা, সততা, বিশ্বস্ততা ইত্যাদি গুণের কথা শুনে তার সঙ্গে অংশীদারিত্বে ব্যবসা করার আহ্বান জানান। মায়সারা নামক খাদিজা (রা.)-এর ভৃত্য সিরিয়াতে দুইবার বাণিজ্য যাত্রায় মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুগামী হয়। ভৃত্য মায়সারার মুখে প্রতিনিধি মুহাম্মদ (সা.)-এর গুণের বিবরণ শুনে, তার বাণিজ্য কুশলতা ও সততার কথা জেনে, তদুপরি তার বিনয়, ভদ্রতা, শিষ্টাচারিতা এবং উত্তম চরিত্রের বিশেষ গুণ দেখে হজরত খাদিজা (রা.) রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য আগ্রহী হন। মুহাম্মদ (সা.)-এর অভিভাবক চাচা আবু তালিবের সম্মতিক্রমে তারা উভয়ে শুভ পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। আল-আমিনের সঙ্গে তাহিরার শুভ মিলন যেন মণিকাঞ্চনযোগ। রাসুল (সা.) হজরত খাদিজাকে (রা.) নিয়ে ২৫ বছর দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করেন। খাদিজা (রা.)-এর ৬৫ বছর বয়সে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। একমাত্র ইবরাহীম (রা.) ছাড়া রাসুল (সা.)-এর সব সন্তানই হজরত খাদিজা (রা.)-এর গর্ভজাত। হিজরতের তিন বছর পূর্বে নবুওয়াতের দশম বছরে ১১ রমজান উম্মত জননী হজরত খাদিজা (রা.) ইন্তেকাল করেন।

২. হজরত সাওদা বিনতে জামআ (রা.) : হজরত খাদিজা (রা.)-এর ইন্তেকালের পর সাওদা (রা.) রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। ইতোপূর্বে সুকরান ইবনে আমরের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। হজরত সুকরান (রা.) মৃত্যুবরণ করলে প্রিয়নবী (সা.) তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। তখন তাদের উভয়ের বয়স ছিল ৫০ বছর। উম্মুল মুমিনীন হজরত সাওদা বিনতে জামআ (রা.) ২২ হিজরী সনে হজরত ওমর (রা.)-এর খেলাফতের শেষের দিকে ইন্তেকাল করেন। তাকে জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়।

৩. হজরত আয়েশা বিনতে আবু বকর সিদ্দিক (রা.) : নবুওয়াতের দশম বর্ষে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.)-এর কন্যা আয়েশা (রা.)-এর বিয়ে হয়। তখন তার বয়স ছিল ছয় বছর। ইবনে হিশামের মতে হজরত আয়েশার বয়স ছিল সাত বছর। হিজরীর দ্বিতীয় সনের শাওয়াল মাসে তাকে নবীগৃহে আনা হয়। তখন তার বয়স হয়েছিল নয় বছর। হজরত আয়েশা (রা.) ৫৭ হিজরীর ১৭ রমজান রোজ মঙ্গলবার ৬৬ বছর বয়সে ইবনে মদীনায় ইন্তেকাল করেন। তাকে জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়।

৪. হজরত হাফসা বিনতে উমর (রা.) : ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.)-এর কন্যা হজরত হাফসা (রা.)। ইতোপূর্বে খুনায়স ইবনে হুজাফা (রা.)-এর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তার স্বামী বদর যুদ্ধে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে শহিদ হলে রাসুল (সা.) তাকে বিয়ে করেন। তিনি অতিমাত্রায় সিয়াম পালনকারিণী এবং রাতের বেলায় খুব বেশি ইবাদাত করতেন। তার সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, রোযা অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন।

৫. হজরত জায়নব বিনতে খুজায়মা (রা.) : হজরত জায়নব (রা.) ছিলেন কুরায়শ গোত্রের শাখা গোত্র আসাদ ইবনে খুযায়মা গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যা। হজরত জায়দ তাকে তালাক দিলে রাসুল (সা.) তাকে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ করে নেন। তিনি ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। তার উপমান ছিল ‘উম্মুল মাসাকিন’ তথা গরীবের মাতা। দরিদ্রদের প্রতি অত্যধিক সহানুভূতিশীল ও অতিশয় সদয় ছিলেন বলে তিনি এ নামে খ্যাত। তার প্রথম বিয়ে হয় তুফায়ল ইবনে হারিসের সঙ্গে। তুফায়লের সঙ্গে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটলে আবদুল্লাহ ইবনে জাহশ (রা.)-এর সঙ্গে তার দ্বিতীয় বিয়ে হয়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জাহশ (রা.) জিহাদের ময়দানে শহীদ হয়ে গেলে বৈধব্যদশায় হজরত জায়নবকে (রা.) মুহাম্মদ (সা.) বিয়ে করেন। তার মৃত্যু হয় রাসুল (সা.)-এর ওফাতের পরে সকর্যওয়াজে মুতাহ্হারাতের আগে। তবে মুহাদ্দিসগণ তো এ ব্যাপারে একমত যে, হজরত জায়নব বিনত খুযায়মা (রা) রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেন।

৬. হজরত উম্মে সালমা বিনতে আবি উমাইয়্যা (রা.) : তার প্রথম বিয়ে হয় আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল আসাদ (রা.)-এর সঙ্গে। কিন্তু হজরত আবদুল্লাহ (রা.) উহুদ যুদ্ধে মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে কিছুদিন পর ইন্তেকাল করেল। তার ইন্তেকালের সময় উম্মে সালমা (রা.) গর্ভবতী ছিলেন। সন্তান প্রসবের পর ইদ্দত শেষ হলে রাসুল (সা.) তাকে স্ত্রী হিসেবে বরণ করে নেন। তার মৃত্যু সন নিয়ে মতভেদ আছে। তবে প্রসিদ্ধ মত হলো, ৬৩ হিজরীর শেষের দিকে তার মুত্যু হয়।

৭. হজরত উম্মে হাবিবা বিনতে আবু সুফয়ান (রা.) : হজরত উম্মে হাবিবা (রা.)-এর প্রথম বিয়ে হয় উবায়দুল্লাহ ইবনে জাহশ আল-আসাদীর সঙ্গে। উবায়দুল্লাহ খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করায় উভয়ের মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হলে রাসুল (সা.) তাকে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ করেন। উম্মে হাবিবা (রা.) ৪৪ হিজরিতে মদিনায় ইন্তেকাল করেন।

৮. হজরত মায়মুনা বিনতে আল-হারিস (রা.) : তার প্রকৃত নাম ছিল ‘বাররা’। রাসুল (সা.) তার ইসলামি নাম রাখেন মায়মুনা। হজরত মায়মুনা (রা.)-এর পূর্ববর্তী স্বামী আবু রুহুম ইবনে আবদুল উজ্জার মৃত্যুর পর হজরত আব্বাস (রা.)-

এর প্রচেষ্টায় প্রিয়নবী (সা.) তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি হজ আদায়ের জন্য মক্কায় যান। হজ শেষে সেখানেই ইন্তেকাল করেন। হজরত ইবন আব্বাস (রা.)-এর নির্দেশে তাকে কাঁধে করে সারাফে আনা হয় এবং সেখানে দাফন করা হয়।

৯. হজরত জুওয়ায়রিয়া বিনতে আল-হারিস (রা.) : তিনি ছিলেন বানু মুসতালিক গোত্রপতি আল হারিসের কন্যা। তার প্রথম স্বামী মুসাফি ইবনে মাফওয়ান আল-মুরায়সি যুদ্ধে নিহত হলে তিনি যুদ্ধবন্দি হয়ে মদিনায় আনা হন। রাসুল (সা.) হজরত জুওয়ায়রিয়াকে (রা.) বন্দিশালা থেকে মুক্ত করে স্বীয় পতিœত্বে বরণ করে নেন। ৬৭০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাকে জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়।

১০. হজরত সাফিয়্যা বিনতে হুয়ায়্যি (রা.) : তার প্রথম বিয়ে হয় ইয়াহুদী গোত্র বানু কুরায়যার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি সাল্লাম ইবনে মাশকামের সঙ্গে। তাদের বিয়ে বিচ্ছেদ হওয়ার পর বানু নাদীরের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি কিনানা ইবনুর রাবির সঙ্গে তার পুনর্বিয়ে হয়। কিনানা খায়বার যুদ্ধে নিহত হলে হজরত সাফিয়্যা (রা.) বিধবা অবস্থায় বন্দি হয়ে রাসুল (সা.)-এর সম্মুখে আনা হলে তিনি তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে নেন। হিজরির ৫০ সনে তিনি পরলোক গমন করেন।

লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, কেবল আয়েশা (রা.) ছাড়া প্রিয়নবী (সা.) আর কোনো কুমারী নারী বিয়ে করেননি। ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি ছিলেন অবিবাহিত। তার যৌবনে এই তিনি বিয়ে করলে পুত্রকন্যাবতী ৪০ বছরের বয়সী এক বিধবাকে। নিজ জীবনের আরো ২৫ বছর অর্থাৎ প্রিয়নবী (সা.) তার ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত এই বৃদ্ধাকেই স্ত্রীরূপে গ্রহণ করে পরিতুষ্ট ছিলেন। এর মধ্যে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। বরং বাকি স্ত্রীদের তিনি গ্রহণ করেন পঞ্চাশোর্ধ্ব। ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও মানবিক বিভিন্ন উদ্দেশে রাসুল (সা.) জীবনের শেষ বয়সে এতগুলো বিয়ে করেন।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist