ফয়জুন্নেসা মণি

  ১৩ জানুয়ারি, ২০১৮

তথ্যব্যাংক

বুদ্ধিমত্তার জন্য মাছ

মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষায় ও পুষ্টিকরণে আমিষের বিকল্প নেই। আমিষের প্রধানতম উৎস হলো মাছ। সুস্থ-স্ব^াভাবিক তীক্ষè আইকিউসম্পন্ন শিশু পেতে চাইলে গর্ভাবস্থ’ায় মহিলাদের বেশি করে মাছ ও সামুদ্রিক খাবার গ্রহণ করা প্রয়োজন। গর্ভবতী মহিলারা প্রয়োজনের তুলনায় এসব খাবার কম খেলে শিশুর স্নায়ুবিক দুর্বলতার কারণে বিভিন্ন জটিলতাও দেখা দিতে পারে। ব্যাহত হতে পারে মানসিক বিকাশ। যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি যৌথভাবে একটি পরামর্শপত্র প্রকাশ করে যাতে বলা হয়, গর্ভবতী মহিলাদের সপ্তাহে ১২ আউন্সের বেশি সাধারণ মাছ এবং কাঁকড়া ও চিংড়ি জাতীয় খোলসি প্রাণী ও মাছ খাওয়া উচিত নয়। কারণ এসবে টক্সিন বেশি থাকে। হাঙর ও টাইল ফিশসহ কিছু প্রাণী এবং মাছ খেতেও নিষেধ করা হয়। কিন্তু গবেষকরা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এ সতর্ক প্রচারণা ভুল প্রমাণ করলেন। গর্ভাবস্থায় মাছ খেলে সন্তানের বুদ্ধি বাড়বে। ব্রিটেনের নয় হাজার মা ও তাদের শিশুদের নিয়ে আট বছর ধরে এ গবেষণা করে ব্রিটেনের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ, ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টল ও যুক্তরাষ্ট্র্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়েসের গবেষকরা বলেছেন, গর্ভবতী মহিলারা মাছ ও সামুদ্রিক খাবার প্রয়োজনমতো গ্রহণ না করলে শিশুর স্ব^াস্থ’্য দুর্বল হতে পারে। বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে তারা অনেক পিছিয়ে থাকতে পারে। সামাজিক ক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা এবং বোধশক্তি কম হতে পারে।

কথায় আছে, ‘ভাতে মাছে বাঙালি’। বাংলায় মাছ, সংস্কৃতে মৎস্য, ইংরেজিতে ফিশ। বিজ্ঞানীদের মতে, মাছই প্রথম জলজ মেরুদন্ডি প্রাণী। প্রাণিজ আমিষের প্রধান উৎস এ মৎস্যসম্পদ মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে প্রাপ্ত প্রাণিজ আমিষের মধ্যে মাছ থেকে পাওয়া যায় ৬৩ ভাগ। আমাদের দৈনিক মাথাপিছু কমপক্ষে ৩৫ গ্রাম মাছের প্রয়োজন। কিন্তু সরবরাহের পরিমাণ দৈনিক মাথাপিছু ২৮ গ্রাম; যা চাহিদার তুলনায় কম। অস্ট্রেলিয়ার একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মাছ হাইপারটেনশন কমিয়ে দেয় এবং মুটিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। ওই গবেষণায় আরো দেখা যায়, ওজন কমাতে যে ডায়েটগুলো মানা হয় তার চাইতে বেশি কাজ করে খাদ্য তালিকায় নিয়মিত মাছের উপস্থিতি। হার্টকে সুস্থ রাখতে খাদ্য তালিকায় মাছের তেল থাকতে হবে। মাছের তেলে ওমেগা-থ্রি থাকে, যার কারণে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়। রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে ভালো কোলেস্টেরল বাড়ায়। ফলে স্ট্রোকের মাত্রা ও ঝুঁকি কমে যায়। যারা হৃদরোগে ভুগছেন তাদের যখন সব তৈলাক্ত খাবার পরিহার করতে হয়, তখন মাছের তেলই তাদের ভরসা। মাছের তেলে ক্ষতিকারক দিকগুলো কম থাকায় তা উপাদেয়। চুলের স্বাস্থ্য এবং ত্বক সুরক্ষিত রাখতে এমনকি নানা ধরনের রোগবালাই থেকে রক্ষা করে মাছের তেল। তাই স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মাছের তেলের বিকল্প নেই। গবেষকরা বলেছেন, যারা সিভিয়ার হাঁপানি (অ্যাজমা) রোগে ভুগছেন তাদের উচিত নিয়মিত মাছ খাওয়া। মাছের তেলে ওমেগা-থ্রি থাকে, যা স্তন এবং প্রোস্টেট ক্যানসার প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। মাছের তেল মায়ের গর্ভের শিশুর মস্তিষ্ক এবং চোখের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া শিশুর অকাল জন্ম, গর্ভপাত এবং জন্মের সময় শিশুর ওজন কম হওয়া থেকে রক্ষা করে মাছের তেল।

আবার পেনসিলভানিয়ার একটি গবেষণা দল চীনের ৫০০ শিশুর ওপর এ-সংক্রান্ত একটি গবেষণা পরিচালনা করে। গবেষণায় অংশ নেওয়া শিশুদের বয়স ছিল নয় থেকে এগারো বছর। তাদের প্রত্যেককে প্রশ্ন করা হয়েছিল তারা মাছ খায় কি না, খেলেও কত দিন পর পর খায়। এরপর তাদের আইকিউ টেস্ট নেওয়া হয়। ফলাফলে দেখা যায়, যেসব শিশু নিয়মিত মাছ খায় (সপ্তাহে অন্তত একবার) তারা আইকিউ টেস্টে অন্যদেও থেকে গড়ে ৪ দশমিক ৮ পয়েন্ট বেশি পেয়েছে। পাশাপাশি ওইসব শিশুর বাবা-মায়ের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তাদের সন্তানদের ঘুম কেমন হয়? তাদের উত্তর থেকে গবেষকরা দেখতে পান, যেসব শিশু নিয়মিত মাছ খায় তাদের ঘুমও ভালো হয়। গবেষকরা বলেন, মাছে শিশুদের বুদ্ধি বিকাশের অতি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাটি অ্যাসিড ওমেগা-থ্রিএস থাকে। স্যামন, সার্ডিন, টুনা জাতীয় মাছে এ ধরনের ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে। এ কারণে যেসব শিশু নিয়মিত মাছ খায় তাদের বুদ্ধির বিকাশ ভালো হয়, ঘুমও ভালো হয়। তার পরও সত্যি হলোÑশিশুরা মাংস খেতে পছন্দ করে। তারা সহজে মাছ খেতে চায় না। সায়েন্টিফিক রিপোর্টের এক জার্নালে বলা হয়েছে, যেসব শিশু সপ্তাহে অন্তত এক দিন মাছ খায়, তাদের ঘুম ভালো হয়, আইকিউ টেস্টেও ভালো করে।

জানলে অবাক হবেনÑপৃথিবীতে প্রায় ২১ হাজার ৭০০ প্রজাতির মাছ আছে। এর মধ্যে লোনাপানির মাছ ১৩ হাজার ৩০০ এবং মিঠাপানির মাছ আট হাজার ৮০০। বাংলাদেশে বহু প্রজাতির মাছ এখন বিপন্ন হতে চলেছে। এদের মধ্যে মহাশোল, নান্দিনা, চেওয়া, বাটা, সরপুঁটি, কৈ, মাগুর, পাবদা, খলিশা, মাইড়, শিং, বানি, গনিয়া, ভাঙ্গনা, গুলশা প্রভৃতি। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ মৎস্য উৎপাদনে চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়ার পরপরই সপ্তম অবস্থানে বাংলাদেশ। দেশে মোট বদ্ধ জলাশয়ের পরিমাণ ১২ হাজার ৩৪১ হেক্টর। তার মধ্যে ২৬ হাজার ৫৫০ হেক্টর পুকুর, জলাশয়; ১৮৮ হেক্টর বাঁওড় এবং এক লাখ ৪১ হাজার ৩৫৩ হেক্টর চিংড়ি খামার। বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ। বর্তমানে দেশে প্রায় ১০০টি নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যায়। মৎস্যসম্পদ বিপুল সম্ভাবনার একটি খাত। আমিষ, পুষ্টির জোগান, রফতানি আয় বৃদ্ধিসহ দারিদ্র্যবিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি মৎস্যসম্পদভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়নে রয়েছে উজ্জ্বল সম্ভাবনা। দেশের সচেতন মানুষ, মৎস্যজীবী খামার, মালিক, উদ্যোক্তা, বেকার যুবক-যুব মহিলা, প্রান্তিক ও দরিদ্র মৎস্যচাষি, পোনা আহরণকারী এবং জেলেসহ সবার মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে মৎস্যসম্পদকে রক্ষা ও ব্যাপ্তি বৃদ্ধি, জীবন-জীবিকা এবং বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক আয় নিশ্চিত করা সম্ভব।

ইংল্যান্ডের অ্যাবারডিনে ব্রিটিশ সায়েন্স ফেস্টিভ্যালে উপস্থাপন করা গবেষণা ফলাফলে জানানো হয়Ñ‘স্যাক্রোপিনিয়া’ নামের একটি শারীরিক প্রক্রিয়ার ফলে বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের শরীরে পেশির আকার প্রতিবছর শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত কমতে থাকে। এর ফলে বৃদ্ধ বয়সে ভঙ্গুর হাড় ও হাঁটাচলার অক্ষমতা দেখা দিতে পারে। এক জরিপে দেখা যায়, ৬৫ বছরের বেশি বয়সী নারীরা ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড গ্রহণ করলে তাদের পেশিশক্তি প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। মাছের তেলে ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়। এ ছাড়া বেশি তেলযুক্ত মাছ থেকে প্রাপ্ত ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড হৃদরোগের আশঙ্কাও হ্রাস করে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। ইউনিভার্সিটি অব অ্যাবারডিনের গবেষক ড. স্টুয়ার্ট গ্রের অভিমত, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য খাতের অর্ধেকই ব্যয় হয় স্যাক্রোপিনিয়া সম্পর্কিত বিভিন্ন কারণে। এ গবেষণার জন্য ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী ৬৫ জন নারীকে ১২ সপ্তাহের জন্য প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে দুবার নির্দিষ্ট ব্যায়াম করতে বলা হয়। তাদের মধ্যে অর্ধেককে বিভিন্ন ওষুধ ও খাবারের মাধ্যমে ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড দেওয়া হয়। বাকিদের শুধু অলিভ অয়েল প্লেসেবো ট্যাবলেট দেওয়া হয়। এ প্রক্রিয়ার শুরু ও শেষে এসব নারীর পেশির কর্মক্ষমতা পরিমাপ করে দেখা যায় প্লেসেবো ট্যাবলেট গ্রহণকারীদের পেশির ক্ষমতা বেড়েছে মাত্র ১১ শতাংশ। তবে ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড গ্রহণকারীদের পেশির ক্ষমতা বেড়েছে ২০ শতাংশ।

(সূত্র : মেডিটেক ইনফো হেলথ সায়েন্স ডটকম)

লেখক: কবি ও শিক্ষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist