নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১১ জানুয়ারি, ২০২৪

৩৫ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ২১৬৫৮ কোটি টাকা

দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) খেলাপি ঋণ রেকর্ড ছাড়িয়েছে। বিদায়ি ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ৩৫টি এনবিএফআইয়ের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের এই পরিমাণ খাতটির বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় ৩০ শতাংশ। এই রেকর্ড এনবিএফআই খাতে ব্যাপক ঋণ অনিয়ম ও জালিয়াতির ইঙ্গিত বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের গত সেপ্টেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭২ হাজার ৮০৬ কোটি টাকায়। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ হয়েছে ২১ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২৯.৭৫ শতাংশ। যা একই বছরের জুনের চেয়ে ৯ শতাংশ এবং আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি।

তিন মাস আগে গত জুন শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণ স্থিতি ছিল ৭২ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। ওই সময়ে খেলাপি ঋণ ছিল ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭০৭ কোটি টাকা বা ৮.৫৫ শতাংশ।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৩৪ কোটি টাকা, এপ্রিল-জুন সময়ে ২ হাজার ৯৬ কোটি এবং জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ১ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা।

খাত-সংশ্লিষ্টরা জানান, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে। ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তীব্র প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। এছাড়া নানা অনিয়মের কারণে ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ায় আমানত পেতে সমস্যা হচ্ছে। পাশাপাশি ঋণগ্রহীতাদের ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপ থাকার কারণে অনেকে সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। তাই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ক্রমেই বেড়ে চলছে।

এমন এক সময়ে এই তথ্য সামনে এলো যখন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশের আর্থিক খাতের খেলাপি ঋণ, ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতা, সুশাসনের অভাবসহ অন্যান্য দুর্বলতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে।

বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) সাবেক চেয়ারম্যান, আইপিডিসি ফাইন্যান্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মমিনুল ইসলাম বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে বাহ্যিক চাপ ও সংকটের কারণে দেশের অর্থনীতি চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছে। এ কারণে অন্যান্য খাতের পাশাপাশি এনবিএফআই খাতও কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছর থেকে এনবিএফআইগুলোর ওপর নজরদারি বাড়িয়েছি। এতে এই খাতের খেলাপি ঋণের তথ্য সামনে আসছে।

ঋণ অনিয়ম ও সুশাসনের অভাবের কারণে সম্প্রতি উত্তরা ফাইন্যান্স এবং ফিনিক্স ফাইন্যান্সের মতো কিছু এনবিএফআইয়ের বোর্ড ও পরিচালনায় সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

তবে গত বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক করোনা মহামারির সময় ঋণ পরিশোধের দেওয়া সুবিধা প্রত্যাহার করার পর এই খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এ খাতের ২১ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে ১০টি এনবিএফআইয়ের খেলাপি ৬৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ বা ১৪ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা।

ঋণ অনিয়মের কারণে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৭ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৯৯ দশমিক ০২ শতাংশ। অনিয়মে জর্জরিত আরেক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের (এনপিএল) খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৯৫ শতাংশ।

২০১৯ সালে এই দুটি এনবিএফআইয়ের ঋণ অনিয়মের তথ্য প্রকাশ্যে আসে। কারণ ওই সময়ে তারা আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারেনি। এরপর ক্রমান্বয়ে আরো কিছু এনবিএফআইয়ের দুর্বল আর্থিক অবস্থার তথ্য সামনে আসতে থাকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিআইএফসির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৪৩ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৯৭ শতাংশ। জিএসপি ফাইন্যান্সের পরিমাণ ৭২১ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৯২ দশমিক ৩৭ শতাংশ, ফারইস্ট ফাইন্যান্সের ৮৭৯ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৯৪ দশমিক ৪১ শতাংশ এবং আভিভা ফাইন্যান্সের ১ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৭২ শতাংশ।

মমিনুল ইসলাম বলেন, চলমান সংকটের মধ্যেও আইপিডিসি ফাইন্যান্সসহ কিছু এনবিএফআইয়ের আর্থিক অবস্থা ভালো, তারা ভালো করছে। আইপিডিসির খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৭৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের মাত্র ৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কোম্পানির (আইআইডিএফসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী ও বিএলএফসিএ’র চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ার ভূঁইয়া বলেন, চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এনবিএফআই খাতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি আরো বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক করোনার সময় দেওয়া সুবিধা প্রত্যাহারের পর খেলাপি ঋণ বেড়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে আইআইডিএফসির খেলাপি ঋণ ছিল ৬১১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫৯ শতাংশ।

তিনি আশা প্রকাশ করেন, ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কমে আসবে, যার তথ্য এখনো প্রকাশ করা হয়নি।

তিনি আরো বলেন, ব্যাংকিং খাতে তারল্য ঘাটতির কারণে বেশিরভাগ এনবিএফআই বর্তমানে অর্থ সংগ্রহে লড়াই করছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি থাকায় গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১০টি এনবিএফআইয়ের প্রভিশন ঘাটতি ছিল ২ হাজার ২০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি বলেন, দুর্বল এনবিএফআইগুলোর জন্য মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংক দায়ী। তিনি বলেন, এনবিএফআইগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সঠিকভাবে তত্ত্বাবধান করতে পারেনি। এতে গত কয়েক বছরে এই খাতে বারবার কেলেঙ্কারি ও ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। পাঁচ থেকে ছয়টি দুর্বল এনবিএফআই বন্ধ ও কয়েকটিকে এক করার আহ্বান জানান তিনি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close