জুনাইদ কবির, ঠাকুরগাঁও

  ২৫ জানুয়ারি, ২০২৩

ইতিহাসের জাদুঘর লোকায়ন

কোনো জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য, ভাষা, কৃষ্টি, সংগ্রাম ও সংস্কৃতির নিদর্শনের সংগ্রহশালার আরেক নাম জাদুঘর। কালের ধারাবাহিকতায় দেশ বিদেশে অনেক জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হলেও জাতির শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন স্থান পায়নি এসব জাদুঘরে। তাই খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের জীবন, জীবিকা, সংগ্রামের ইতিহাস ও নিদর্শন সংরক্ষণ করা হয়েছে একটি জাদুঘরে। নাম ‘লোকায়ন-জীবন বৈচিত্র্য জাদুঘর’।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ঠাকুরগাঁও শহর থেকে খানিকটা দূরে পূর্ব আকচা গ্রামে গড়ে তোলা হয়েছে এই জাদুঘর। এর উদ্যোক্তা মুহম্মদ শহীদ উজ জামান। তিনি একটি বেসরকারি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক। এই জাদুঘরে রাজাদের বীরত্বের ইতিহাসের চেয়ে মানুষের শ্রমঘামের বিনিময়ে গড়ে তোলা সামগ্রীই স্থান পেয়েছে বেশি। এখানে শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাপনে ব্যবহৃত নানাসামগ্রী ও তাদের সংস্কৃতির নানা উপকরণের পাশাপাশি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের অনেক দুর্লভ নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যাবে।

লোকায়নের যাত্রা শুরু হয় ২০০৬ সালে ‘তৃণমূল লোকজ গ্যালারি’ স্থাপনের মধ্য দিয়ে। এই গ্যালারিতে কৃষক-খামারি, কামার-কুমার, জেলে-তাঁতি, দিনমজুর, খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের ব্যবহার্য সবকিছুর দেখা মিলবে। এখানে কৃষকের লাঙল-জোয়াল, মই, ফলা, নিড়ানি, দা, কাস্তে, খুন্তি মাথাল, ধান রাখার ডুবি, কৃষকের খেতের ইঁদুর মারার নানা রকমের ফাঁদ, গরুর গলায় বেঁধে দেওয়া ঘুগরা, মুখে দেওয়া টুনা পাওয়া যাবে। এ জাদুঘরে গৃহস্থালি বিভিন্ন পণ্য যেমন ডাল ভাঙার জাঁতা, ঢেঁকি, ছামণ্ডগাইন, হাতুড়ি, শাবল, কোদাল, কুঠার, কামারের হাপর, দড়ি পাকানোর ঢ্যারা, সেচের জোত, মাছ ধরার চাঁই, পলো, জাল, টোটা, খড়ম, বসার মোড়া, পিঁড়ি, হুঁকা, কুপি, হাতপাখাও যত্ন নিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

এই জাদুঘরে আরো আছে ঢাকঢোল, মাদল, বাঁশি, একতারা, দোতারা, সানাই, পালকি, টোপর, কুলা, চালনি, ডাল ঘুঁটনি, শিলপাটা, খুর, পুঁথি, চিঠিপত্র, খাজনা আদায়ের রসিদ, গরুর গাড়ি, সাইকেল, হাতের চুড়ি, বালা, হাসুলি, বাজু, কুয়ো থেকে বালতি তোলার কাঁটা, মাটির সানকি, বাসনকোসন, তরবারি, ঢাল, সড়কি, তির-ধনুক ও বল্লম। বলতে গেলে পুরো বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রাই তুলে ধরার চেষ্টা রয়েছে জাদুঘরটিতে।

শুধু শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা ও সংগ্রামের ইতিহাস উপস্থাপন নয়, এখানে একে একে গড়ে তোলো হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারি’। এ জাদুঘরে ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধ থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেও আলোকচিত্র, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ প্রদর্শন করা হয়েছে। এখানে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণ, রণাঙ্গনের ইতিহাস ও ছোট ছোট বোতলে দেশের বিভিন্ন বধ্যভূমির মাটি। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবনযাপন, সংস্কৃতি, বাসস্থান ও পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, পেশা, উৎসব সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের বিভিন্ন উপকরণে সমৃদ্ধ ‘সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী গ্যালারি’।

এই জাদুঘরে গড়ে তোলা হয়েছে ‘আঞ্চলিক ভাষা গ্যালারি’। এই গ্যালারিতে দেশের ৬৪ জেলার জন্য ৬৪টি সুইচ আছে। যে জেলার সুইচ অন করা হয়, সেই জেলার আঞ্চলিক ভাষার কথা শোনা যায়। আঞ্চলিক ভাষা সংরক্ষণের জন্য এটি একটি অসাধারণ ও অনন্য উদ্যোগ। এখানে রয়েছে ‘নদী গ্যালারি’। যেখানে কাচের বোতলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মরা ও বিলুপ্তপ্রায় নদীর পানি সংরক্ষণ করা হয়েছে। সেখানে তুলে ধরা হয়েছে নদী ও জনজীবন, সংস্কৃতি, উৎসবের তথ্যের পাশাপাশি নানা উপকরণ।

এ ছাড়া মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কিত বর্ষামঙ্গল, নবান্ন, পিঠা উৎসবের মতো নানা উৎসব এখানে উদ্?যাপন করা হয় নিয়মিত। সেসব উৎসবে স্থানীয় লোকনাট্য ধামেরগান, কবিগান, গীত, আদিবাসী গান-নাচ পরিবেশন করা হয়। উৎসবে যোগ দেওয়া অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয় কলাপাতা ও মাটির তৈরি বাসনকোসনে। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকে এ জাদুঘর। গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে বসার জন্য বাঁশ দিয়ে তৈরি মাচা। চেয়ার ও টেবিল তৈরি করা হয়েছে নানা গাছের গুঁড়ি দিয়ে।

জাদুঘরে বেড়াতে আসা শিশুদের বিনোদনের জন্য স্থাপন করা হয়েছে দোলনা, চড়কি, ঢেঁকিসহ নানা ধরনের খেলনা।

শিক্ষার্থী জিনু আহম্মেদ বলেন, বিশ্বে অনেক জাদুঘর আছে। কিন্তু সেগুলোতে খেটে খাওয়া মানুষের ইতিহাস পর্দার আড়ালে রাখা হয়েছে। এই দিক থেকে এই জাদুঘর খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাপন ও সংগ্রামের ইতিহাস ও নিদর্শন তুলে ধরে প্রশংসনীয় কাজ করা হয়েছে।

জাদুঘরের উদ্যোক্তা মুহম্মদ শহীদ উজ জামান বলেন, লোকায়ন শব্দটি কোনো আভিধানিক শব্দ নয়। লোকজ, সংস্কৃতি ও শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা ও সংগ্রামে ব্যবহৃত উপকরণভিত্তিক ওই জাদুঘর যখন লোকমানুষের জন্য, তাই এর নামকরণ করা হয়েছে লোকায়ন।

তিনি আরো বলেন, দেশ-বিদেশের জাদুঘরগুলোতে অন্তরালে রয়ে গেছে শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা ও সংগ্রামের কথা। সংগ্রামী সব মানুষের জীবনগাথা চিরজাগ্রত রাখতেই লোকায়নের এ প্রচেষ্টা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close