হায়দার আলী, পঞ্চগড়

  ০৭ জুলাই, ২০২২

পঞ্চগড়ের রকস মিউজিয়াম

পাথরের বুকে সাড়ে চার হাজার বছরের ইতিহাস

রকস মিউজিয়াম বা পাথরের জাদুঘর। পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের ক্যাম্পাসের ভেতরে এর অবস্থান। শুধু বাংলাদেশে নয় এশিয়ার মধ্যে এ রকম পাথরের জাদুঘর আর দ্বিতীয়টি নেই। তাই তো জেলার বাইরে থেকে আসা পর্যটকদের মূল আকর্ষণ এই পাথরের জাদুঘর। দর্শনার্থীদের চাপে

কর্তৃপক্ষকে বন্ধের দিনও কলেজ ক্যাম্পাস খোলা রাখতে হয়। কলেজের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকলেই মাঠের একপাশে নজরে আসবে বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় পাথর যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এসব পাথরের আকৃতিও ভিন্ন। কিছু পাথরে বিভিন্ন ধরনের সাংকেতিক চিহ্ন আঁকা রয়েছে। কলেজের দক্ষিণ অংশের দেয়াল বরাবর দ্বিতল ভবনের এই জাদুঘরের ভেতর থরে থরে সাজানো রয়েছে হরেক রকমের পাথর। সে সঙ্গে রয়েছে প্রাচীনকালের মানুষের ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিসপত্র। নদী থেকে পাওয়া দুটি বিশালাকার নৌকাও ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে জাদুঘরের ঠিক মাঝখানে।

১৯৯৭ সালে কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ নাজমুল হক ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় গড়ে তোলেন ব্যতিক্রমী এই জাদুঘর। এ অঞ্চলের ভূখন্ডের বয়স নির্ণয়, ভূ-বৈশিষ্ট্য অনুসন্ধান, প্রাগৈতিহাসিক কালের নমুনা সংগ্রহ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং পুরাতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ করার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক এ জাদুঘরটি স্থাপন করা হয়েছে। আদিকাল থেকেই হিমালয় থেকে বয়ে আসা নদীর কারণে এ জেলার ভূগর্ভের অল্প গভীরে রয়েছে প্রচুর নুড়িপাথর। আর মাটির অনেক গভীরে রয়েছে প্রাচীন যুগের শিলাস্তর। মাটির গভীর থেকে পাথর তুলতে গিয়ে বেরিয়ে আসে প্রাচীন যুগের এই প্রস্তুর খন্ড। এই শিলাস্তর সংগ্রহ করে কালানুক্রমিকভাবে গড়ে তোলা হয়েছে রকস মিউজিয়াম বা পাথরের জাদুঘর। জাদুঘরের অভ্যন্তরীণ গ্যালারিতে রয়েছে বিভিন্ন আকৃতি, রং ও বৈশিষ্ট্যের আগ্নেয়শিলা, পাললিক শিলা ও নুড়ি পাথর, সিলিকা নুড়ি ও সিলিকা বালি, হলুদ ও গাঢ় হলুদ বালি, কাচবালি, খনিজবালি, সাদা মাটি, তরঙ্গায়িত চ্যাপ্টা পাথর, লাইমস্টোন, পলি ও কুমোর মাটিসহ কঠিনশিলা। এছাড়াও অন্য গ্যালারিতে একটি জাতিতাত্ত্বিক সংগ্রহশালাও স্থাপন করা হয়েছে। এতে রয়েছে পঞ্চগড় অঞ্চলের আদিবাসী, উপজাতিদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র নদীর নিচে ও ভূগর্ভে প্রাপ্ত অশ্মীভূত কাঠ, ৩০০ থেকে ২ হাজার বছরের পুরোনো ইমারতের ইট, পাথরের মূর্তি এবং পোড়ামাটির নকশা। উন্মুক্ত গ্যালারিতে রয়েছে বিশাল আকৃতির বেলেপাথর, গ্রানাইট পাথর, কোয়ার্টজাইট, ব্যাসল্ট, শেল, মার্বেলসহ বিভিন্ন নামের ও বর্ণের শিলা, সিলিকায়িত কাঠ বা গাছ থেকে পাথর, নকশা করা অলংকৃত খিলান ও সø­াব পাথর, বিভিন্ন রেখা, লেখা ও চিত্রাঙ্কিত শিলা এবং ধূসর ও কালো রঙের কাদা। এখানে রয়েছে দুটি নৌকা। একটিমাত্র শালগাছ কেটে এই বিশাল আকারের নৌকা দুটি তৈরি করা হয়েছে। নৌকার দৈর্ঘ্য ২২ ফুট ৬ ইঞ্চি। এর বয়স প্রায় ৩০০ বছর। এ ধরনের নৌকা প্রাচীনকালের আদিবাসীরা প্রশান্ত মহাসাগরের দীপপুঞ্জে ব্যবহার করত বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন। পঞ্চগড়ের বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগৃহীত কয়েকটি বিশালাকৃতি পাথরে নিয়মিত পূজা নিবেদন করা হতো। কয়েকটি পাথর সম্পর্কে প্রচলিত ছিল অলৌকিক কাহিনি। একটি পাথরের নামে স্থানের নামেই ছিল ‘পাথর ঠাকুর’। বড় বড় বেশ কয়েকটি পাথর সম্পর্কে স্থানীয় মানুষের ছিল খুব ভীতি। পাথর মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছে, কথা বলেছে- প্রচলিত ছিল এমন জনশ্রুতি ও রক্স মিউজিয়ামে রক্ষিত কোনো কোনো পাথরে রয়েছে নান্দনিক কারুকাজ। একটি পাথরে খোদিত রয়েছে ‘তীর-ধনুক’ ও দেবীর চোখের চিত্র। একটিতে খোদিত রয়েছে শ্রী শব্দটি অন্য একটি পাথরে খোদাই করা আছে একটি তিব্বতি চাইনিজ বর্ণমালা। একটি পাঁচফুট লম্বা কোয়ার্জাইট পাথর স্থাপিত হয়েছিল সম্ভবত কোনো সমাধিক্ষেত্রে। পাথরগুলোর বৈশিষ্ট্যগুলো বিশ্লেষণ করে অনেক বিশেষজ্ঞই বলছেন, পাশের দার্জিলিংয়ের সমকালে পঞ্চগড় অঞ্চলেও নব্য প্রস্তুর যুগের সংস্কৃতি ও জীবনাচরণ ভালোভাবেই বিস্তার লাভ করেছিল। বাংলাদেশে এখনো প্রত্ন ঐতিহাসিক ও প্রস্তুর যুগের হাতিয়ার ও উপকরণ খুব বেশি একটা পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধান অব্যাহত রাখলে পঞ্চগড় জেলায় হয়তো প্রস্তুর যুগের প্রত্নবস্তু আবিষ্কৃত হতে পারে।

রকস্ মিউজিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা ড. নাজমুল হক বলেন, ১৯৯০ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত এখানে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করাকালে আমি রক্স মিউজিয়ামটি প্রতিষ্ঠা করেছি। এটি প্রতিষ্ঠা করতে এখানকার জনসাধারণসহ অনেকে আমাকে সহযোগিতা করেছেন। এগুলো অমূল্য সম্পদ। প্রত্যেকটি পাথরের পিছনে নানা রকমের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, জাতিতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক বিভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্য আছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি এবং সাড়ে চার হাজার বছরের যে ইতিহাস সেটা পাথুরে ইতিহাস। অর্থাৎ কোনো অনুমানভিত্তিক না। এটা আমাদের চোখের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। এটা একটা রকস মিউজিয়ামের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করা দরকার তার কারণ হচ্ছে সংগ্রহ করে দেখে দিলে এটার কোনো মর্যাদা থাকে না। রকস মিউজিয়ামের সঙ্গে জড়িত বলে পঞ্চগড়কে সবাই চেনে।

প্রথমত, এটাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে তাহলে পর্যটকরা আকৃষ্ট হবে। দ্বিতীয়ত, গবেষণার কাজটাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সংরক্ষণ, গবেষণা এবং পর্যটকদের সামনে তুলে ধরা- এই তিনটি বিষয় যদি আমরা করতে পারি তাহলে এই অঞ্চলের যে প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিসপত্র ছিল সেগুলোর স্বার্থকতা হবে এবং যারা পরিশ্রম করেছে তাদের স্বার্থকতা হবে। সরকার বা কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার বলে তিনি মনে করেন।

বগুড়া শিবগঞ্জ থেকে এসেছেন শিক্ষক হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, এখানে দেখার মতো প্রাকৃতিক অনেক কিছু আছে। এখানে ডিঙ্গি নৌকা, পাথর অনেক কিছুর সঙ্গে পরিচিত হলাম। ভবিষ্যতে আমার এই বাস্তব অভিজ্ঞতা পরের প্রজন্মের সঙ্গে তুলে ধরতে পারব। বাবা-মায়ের সঙ্গে রকস মিউজিয়াম দেখতে আসা শ্রাবণী (৮) বলে, আমার এই মিউজিয়ামটা খুব ভালো লাগছে।

বগুড়া থেকে আসা পর্যটক অলক সরকার (৪০) বলেন, আমি বগুড়া থেকে এ রকস মিউজিয়ামটি দেখার জন্য এসেছি। রকস মিউজিয়ামটি দেখে আমার অনেক ভালো লাগল।

পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. মাইনুর রহমান বলেন, এই কলেজের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর ক্যাম্পাসে রয়েছে একটি রকস মিউজিয়াম। যেটি বাংলাদেশের একমাত্র রকস মিউজিয়াম। এটি আমার কলেজকে শুধু নয় অত্র এলাকাকে বিশেষ মাত্রাযুক্ত করেছে এবং পর্যটনের জন্য পঞ্চগড়কে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close