বদরুল আলম মজুমদার

  ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১

নাইন স্টার গ্রুপের দৌরাত্ম্য খুদে ব্যবসায়ীরা অসহায়!

রাজধানী উত্তরার ৬নং সেক্টরে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী কাঁচাবাজার দখল করে রাখার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। প্রকৃত সমবায়ীদের হাত থেকে বাজারটি দখল করে রেখেছে আলী রাজের নেতৃত্বে একটি সংঘবদ্ধচক্র নাম নাইন স্টার গ্রুপ। এ দখল নিয়ে খুদে পুঁজির সমবায়ীরা বিভিন্ন জনে দেনদরবার করেও প্রতিকার পাচ্ছেন না। ক্ষমতায় ছত্রছায়ায় থেকে দখলবাজ চক্রটি ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে টাকা-পয়সা আদায় করছে। তবে দখলবাজ এবং প্রকৃত সমবায়ী উভয়পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলছে। একপক্ষ চাচ্ছে বাজারটি প্রকৃত সমবায়ীদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। অন্যপক্ষটি দখল পোক্ত করার জন্য গোপনে নানামুখী তদবিরে ব্যস্ত।

জানা গেছে, ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। বাজারে দাম ঠিক রাখতে তখন বিডিআরের উদ্যেগে রাজধানীতে ৩২টি কাঁচাবাজার স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে উত্তরা রাজউক কলেজের সামনে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ২ একর জায়গার ওপর বিডিআরের নেতৃত্বে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের ডেকে এনে ৫০০টি দোকান ঘর স্থাপন করে। দোকান নেওয়া ব্যক্তিরা ছিলেন অধিকাংশই অতি নিম্ন আয়ের মানুষ। সেই সময় ঝড়বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য বিডিআর উদ্যোগে বাজারের ওপর টিনের চাউনিও দেওয়া হয়। পরে জরুরি সরকার চলে যাওয়ার সময় বিডিআর এর সরাসরি তত্বাবধানে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দিয়ে একটি সমবায় সমিতি গঠন করা হয়েছিল এবং সমিতির নামেই বাজারে পানি, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন ইউটিলিটির কাগজপত্র সমবায়ীদের নামে করা হয়। মূলত বাজারে বৈধ মালিকানাসহ যাবতীয় বিল কালেশনের দায়িত্বও তাদের হাতে। বাজার সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায় এভাবে ৮ থেকে ১০ বছর সমবায়-কমিটির মাধ্যমে বাজার পরিচালনা করেন গরিব শ্রেণির ব্যবসায়ীরা। কিন্তু ২০১৮ সালের শেষ দিকে কথিত নাইন স্টার গ্রুপের প্রধান আলী রাজের নেতৃত্বে ফিল্মি স্টাইলে বাজারটি দখল করা হয়। বহিরাগত হিসেবে আলী রাজ গ্রুপ বাজারের দখল নিয়ে সমিতির লোকজনকে বিদায় করে দেয়। তখনকার সময়ে বাজার কমিটি প্রতিবাদও করে। পরে প্রতিবাদকারীদের অনেককেই আক্রমণ করে মারাত্মক জখম করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে দখলবাজরা। প্রতিবাদকারীদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুটপাটসহ বাসাবাড়িতে গিয়ে পরিবার-পরিজনকে হুমকি-ধমকি দিয়ে আসে তার সন্ত্রাসীরা। এমন অবস্থায় সমিতির প্রতিবাদী গ্রুপটি প্রাণ ভয়ে অনেক দিন বাজার থেকে দূরে সরে থাকতে বাধ্য হয়। সে সময় বাজার কমিটির ব্যানারে একাধিক সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধন করা হয় আলীরাজের সন্ত্রাসী কর্মকা-ের বিরুদ্ধে। কিন্তু ক্ষমতার ছত্রছায়া থাকায় আলী রাজের টিকিটিও ধরতে সাহস পায়নি কেউ।

তবে বাজার সমিতির একজন শীর্ষ নেতা প্রতিবেদককে বলেন, বহিরাগত আলী রাজ গ্রুপের সদস্যদের অত্যাচারে আমরা অতিষ্ঠ। আমরা বৈধ মালিক হলেও এখানে দোকানদারি করতে চাঁদা দিতে হয়। দোকান ভাড়া বা বিক্রি করতে গেলেও লাখ টাকা দিতে হয় আলী রাজকে। এ অবস্থায় আমরা অসহায় হয়ে আছি। কেউ আমাদের পক্ষে কথা বলে না। বাজার সম্পর্কে আমাদের সমস্যা নিয়ে আমরা প্রশাসনের অনেক জায়গায় গিয়েছি, কোনো প্রতিকার পাইনি। এখন আমরা স্থানীয় প্রশাসনসহ স্থানীয় সংসদ সদস্যের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

স্থানীয়ভাবে অনুসন্ধান করে জানা যায়, ২০১৮ সাল থেকে ৫০০ শতাধিক দোকানে ইউটিলিটি বিল বাদে প্রতিদিন ৫০ টাকা হারে চাঁদা আদায় করছে আলী রাজ ও শাওনের লালিত গ্রুপের সদস্যরা। আলী রাজ ছাত্রলীগের একজন সাবেক নেতা। রাজধানীর উত্তরখান নিবাসী এ ছাত্রনেতা প্রয়াত এমপি সাহারা খাতুনের পিএস মজিবুর রহমানে ছত্রছায়ায় তার শক্তির ডালপালা মেলেন উত্তরা ৪ ও ৬নং সেক্টর এলাকায়। এ গ্রুপের সদস্যরা এলাকায় চিঁচকে চুরি থেকে শুরু করে বড় ধরনের চুরি, চিনতাই ও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। তৎকালীন সময়ে দেশের একাধিক গণমাধ্যমে এ নিয়ে সংবাদও প্রচার হয়। এ বিষয়ে ২০১৮ সালে উত্তরা পূর্ব থানায় দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ কর্মকর্তার তদন্তেও বিষয়গুলো উঠে আসে। সেই সময় একটি জাতীয় দৈনিকে দেওয়া বক্তব্যে আলী রাজ এবং থানার তদন্ত কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে পুলিশ আলী রাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি। তখন থেকে এই গ্রুপের লোকজন এলাকার কাউকেই পাত্তা দিত না। পুলিশও এই গ্রুপের লোকজনকে ঘাটাতে যেত না। সাহারা খাতুনের পিএস ‘মুজিবর মামা’র কারণেই তাদের এ উত্থান হয়েছিল। যদিও ‘মজিবর মামা’ সেটি আজো স্বীকার করছেন না। এ বিষয়ে মজিবর মামা প্রতিবেদককে বলেন, আলী রাজ ছাত্রলীগ করত, সেই হিসেবে সে আমার পরিচিত। আমি তাকে বাজার দখলের জন্য কোনো পৃষ্ঠপোষকতা করিনি। করার প্রশ্নও আসে না।

তবে মজিবর মামা অস্বীকার করলেও অভিযোগ আছে তার ছত্রছায়ায় আলী রাজ সমিতির সদস্য না হয়েও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে গঠিত সুন্দর একটি কাঁচাবাজার সন্ত্রাসী কায়দায় দখল নেয়। গত ৫ বছর থেকে খেটে খাওয়া মানুষের রক্তচুষে আলী রাজ গং এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। অথচ বিষয়টি নিয়ে থানা পুলিশসহ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ কেউই প্রশ্নও তুলছেন না। বাজার দখল করে আলী রাজের নীরব চাঁদাবাজির বিষয়ে অনেক সংবাদ প্রচার হলেও কাজের কাজ কিছুই হয় না। অভিযোগ আছে, নিজের দখল চাঁদাবাজি পোক্ত করতে আলী রাজ গং এখন জাতীয় মিডিয়ার অনেক সাংবাদিককে ম্যানেজ করে নিজের দৌরাত্ম্য বাড়িয়েছেন কয়েকগুণ।

যদিও আলী রাজ নিজেকে নাইন স্টার বাহিনীর প্রধান বা এর সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করছেন। তিনি বলেন, আমি এ বিষয়ে দুটি পত্রিকায় প্রতিবাদ পাঠিয়েছি এবং সেটি গুরুত্ব দিয়ে চাপানোও হয়েছে। স্বনামধন্য একটি একটি জাতীয় দৈনিকে তার বিরুদ্ধে প্রকাশিক সংবাদটি ভিত্তি নেই বলে একটি প্রতিবাদ দিয়েছেন তিনি। নিউজটি বাজার দখল সংশ্লিষ্ট হলেও সেখানে এ বিষয়ে একটি কথাও লিখেননি তিনি। বাজার দখলের বিষয়ে আলী রাজ প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আমরা বাজার দখল করিনি, আমরা সমবায়ীদের অবৈধ কার্যক্রম বন্ধের জন্য প্রতিবাদ করেছিলাম। সেই প্রতিবাদের পর থেকে সবাই আমাকে মার্কেটের নেতা বানিয়ে দেয়। সেই থেকে আমি দায়িত্ব পালন করছি। সমবায়ীদের উৎখাত করার অধিকার আপনার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সমবায়ের নেতারা জামায়াত-বিএনপির সদস্য। তার ব্যাপারে একাধিক নিউজের বিষয়ে বলা হলে তিনি বলেন, আমাদের পক্ষে অনেক প্রথম শ্রেণির জাতীয় দৈনিকে পজিটিভ সংবাদ প্রচার হয়েছে, সেগুলো কি আপনি দেখেন না।

এ বিষয়ে উত্তরা ৬নং সেক্টর কাঁচাবাজার বহুমুখী সমবায় সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা যখন সমবায় সমিতি গঠন করি তখন বাজারের অন্য একটি গ্রুপ শ্রমিক আইনের অধীনে একটি ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করে। মূলত আলী রাজ ২০১৯ সালে সেই ট্রেড ইউনিয়নে ডুকে নিজে সভাপতি হয়ে যায়। এটা সমবায় থেকে অনুমোদিত সংগঠন নয়। এটা বাজারের কর্মচারীদের একটা সংগঠন। সেই সংগঠনের দোহাই দিয়েই বাজারটি কব্জায় নেয় তারা। আর ২০০ টাকা উত্তোলনের যে বিষয়টি বলা হচ্ছে, হ্যাঁ আমরা সেটা করেছি রশিদ দিয়ে। উচ্চক্ষমতার বিদ্যুৎ লাইন স্থাপনের জন্য ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা খরচের বিষয় রয়েছে। তাই আমরা ৫১ সদস্যের একটি উপকিমিটি করে সংগৃহীত টাকার জন্য রশিদ দিয়েছিলাম, এটা চাঁদাবাজি নয়, আমরা মার্কেটের কাজের জন্য টাকা সংগ্রহ করেছি। আমাদের সব কাজ রেজ্যুলেশন করে করি। সভা করে রেজ্যুলেশন আকারে যা করি সমিতি আইনে তা বৈধ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close