এস এম রাজু, জৈন্তাপুর (সিলেট)

  ১০ ডিসেম্বর, ২০১৮

ছিঁচকে কবিরাজ থেকে দুর্ধর্ষ খুনি কালাম হুজুর

সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর পৌর এলাকার নিখোঁজ লন্ডন প্রবাসী আব্দুল গফুর হত্যার মূল আসামি কালাম হুজুরকে (৫২) গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে তার দুর্ধর্ষ খুনের ঘটনা বের হয়ে আসছে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সব কথা আদালতকে জানিয়েছেন তিনি। তার পুরো নাম মওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে কালাম হুজুর। এলাকায় ‘কবিরাজ’ নামে পরিচিত রয়েছে তার। জৈন্তাপুর উপজেলার সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্রের অফিস সহকারী ছিলেন আর করতেন ছিঁচকে কবিরাজি। আর কবিরাজির আড়ালে তিনি ধীরে ধীরে হয়ে উঠেন দুর্ধর্ষ খুনি।

তার মোবাইলের কললিস্টে একাধিক নারীর ফোনালাপের তথ্যচিত্র পাওয়া গেছে। তার ঝাড়-ফুঁ ও তন্ত্রমন্ত্রেও প্রতারণার ফাঁদে সর্বস্বান্ত হয়েছেন বহু নারী এবং সহজ সরল মানুষ। এই ফাঁদে পা দিয়ে জীবনটাই হারিয়েছেন হতভাগা লন্ডন প্রবাসী আব্দুল গফুর। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি, ধ্বংস হয়ে গেছে নিহত গফুরের পরিবার ও তার স্ত্রী সন্তানদের ভবিষ্যৎ। কালাম হুজুরের অপরাধের মিথ্যা দায় টেনে বেড়াচ্ছেন মোকামটিলা গ্রামের জুনাব আলী। কারণ তাকেও করা হয়েছে গফুর হত্যা মামলার আসামি।

জানা গেছে, অল্প দিনেই কালাম হুজুর অর্জন করেছেন অগাধ সম্পদ। জৈন্তাপুর সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম গেটসংলগ্ন ‘হামনাত’ মঞ্জিলের আলিশান বাড়ির মালিক তিনি। জৈন্তাপুর বালিকা বিদ্যালয়ের পাশের জমিটাও তার। সারিঘাট রাস্তার পাশে তিন বিঘা জমিও রয়েছে হুজুরের। বটেশ^র সেনানিবাস-সংলগ্ন ফ্ল্যাটবাড়ি নির্মাণ করেছেন কালাম হুজুর। এলাকাবাসী বলছেন, একজন অফিস সহকারী কীভাবে বিশাল সম্পদের মালিক হন, তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের যাবতীয় তথ্য উদঘাটনে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাজ্য প্রবাসী আব্দুল গফুর ২০১৭ সালে ৮ মে দেশে ফেরেন। কালাম হুজুর তার পরিচিত। গফুরের দেশে আসার বিষয়টি জানতে পেরে ওইদিন ঘাতক কালাম হুজুর সহযোগীদের নিয়ে সিলেট শহরে গিয়ে প্রবাসী আব্দুল গফুরকে ফুঁসলিয়ে সিলেটের হোটেল রাজমনীতে (আবাসিক) নিয়ে আসেন। হোটেলের ২১২নং কক্ষে তারা অবস্থান নেন। হোটেল রেজিস্ট্রারে গফুরের নাম-ঠিকানা এবং আসামির মোবাইল নম্বর প্রদান করা হয়। এ সময় গফুর তার বাল্যবন্ধু জগন্নাথপুর গ্রামের নূরুল হককে ওই হোটেলে দেখা করার অনুরোধ করেন। কিন্তু ওইদিন নূরুল হক তার মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকায় দেখা করতে পারেনি। এরপর থেকেই আব্দুল গফুর নিখোঁজ হন।

অনেক খোঁজাখুঁিজ করে তাকে না পেয়ে গফুরের ভাগিনা লাল মিয়া গত ২৬ অক্টোবর ২০১৮ইং ওই মোবাইল নম্বর উল্লেখ করে জগন্নাথপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। পুলিশ ওই ফোনকলের সূত্র ধরে গত ২৫ নভেম্বর রোববার অভিযান চালিয়ে কালাম হুজুর ও তার সহযোগীদের আটক করে। জিজ্ঞাসাবাদে কবিরাজ কালাম হুজুর ও তার জামাতা গফুর হত্যার কথা স্বীকার করেন। তারা জানান, জামাতা আনোয়ার ১০ লাখ টাকার লোভে সিএনজির ভেতরেই গফুরকে প্রথমে অজ্ঞান করে পরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন।

তার আগে হত্যার দায় এড়াতে গফুরের লাশ সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান তারা। গফুর হাসপাতালে মারা গেছেন মর্মে হাসপাতাল থেকে মৃত্যুর সনদ সংগ্রহ করেন এবং লাশ জৈন্তাপুরে নিয়ে আসেন। এলাকায় জানানো হয়, নিহত ব্যক্তি তার আপন চাচাতো ভাই। অসুস্থ হয়ে ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। ওর আর কেউ নেই। এ কথা বলে জৈন্তাপুর উপজেলা মোকামটিলা এলাকায় কবর দেন তারা।

ওই হত্যাকান্ডের দেড় বছর পর গ্রেফতার কালাম হুজুরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পুলিশ সিলেট দরগা মহল্লাস্থ রাজমনী হোটেল কক্ষ থেকে নিহত আব্দুল গফুরের ব্যাগ এবং তার জামাতার বাড়ি জৈন্তাপুর উপজেলার তোয়াশী হাটির বাসা থেকে দুটি পাসপোর্ট এবং লন্ডন থেকে বাংলাদেশে আসার বিমান টিকিটসহ বিভিন্ন আলামত উদ্বার করে।

এদিকে, এলাকাবাসী ওই হত্যাকান্ডের ঘটনায় জুনাব আলীকে নির্দোষ দাবি করেছেন। জৈন্তাপুর উপজেলার ১নং নিজপাট ইউপি চেয়ারম্যান মঞ্জুর এলাহী স¤্রাট বলেন, জুনাব আলী একজন সহজ-সরল প্রকৃতির লোক। তার নামে এলাকায় কোনো ধরনের অভিযোগ নেই। তিনি একজন খাদ্যগুদামের শ্রমিক এবং মোকামটিলা মসজিদের ক্যাশিয়ার। দীর্ঘ ২০-৩০ বছর যাবৎ কবর খননের কাজ করতেন। গফুরের কবর খননের কারণেই তাকে ফাঁসিয়েছেন কালাম হুজুর।

আবুল কালাম আজাদের মেয়ে উম্মে তানজিলা ও উম্মে হাফসা বলেন, ‘আমাদের বাবা আবুল কালাম আজাদ একজন মওলানা। তিনি এ ধরনের জঘন্য কাজ করতেই পারেন না। পুলিশ অন্যায়ভাবে ধরে নিয়ে গিয়ে গেছে।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জগন্নাথপুর থানার এসআই হাবিবুর রহমান বলেন, কালাম হুজুরের নাম্বারে কল করলে রং নাম্বার বলে ফোন কেটে দিত। অবশেষে মহিলা দিয়ে ‘কবিরাজি’ করানোর নাম করে তার পরিচয় জানতে পারি। তার মোবাইলের কললিস্ট থেকে তথ্য বেরিয়ে আসে। লাল মিয়ার দায়েরকৃত সাধারণ ডায়েরি হত্যা মামলায় রূপান্তর করা হয়েছে। আসামিদের আটক করে সুনামগঞ্জ কোর্টে প্রেরণ করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আদালতে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেছি। তবে রিমান্ডের শুনানি এখনো হয়নি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close