রাকিবুল রাকিব, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ)

  ১৯ অক্টোবর, ২০১৮

ঢাকের তালে জীবন চলে

একজনের গলায় ঢোল, আরেকজনের কাঁধে ঢাক আর অপরজনের হাতে ঝুমুর। তিনটি বাদ্যযন্ত্রই বেজে চলছে এক সঙ্গে। বাজনার তালে তালে তারা তিনজন নাচছেন। সেই তালে কিছুটা মেতে উঠেছেন চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শনার্থীরও। হেলে-দুলে, নেচে-গেয়ে, তারাও বিষয়টা উপভোগ করেছেন। গত মঙ্গলবার রাত ১০টায় ঢাক-ঢোলের এই বাজনার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য ধরা পড়ল গৌরীপুর পৌর শহরের মধ্যবাজার এলাকার দুর্গাপূজা মন্ডপে। এখানে ঢাক-ঢোল বাজাতে এসেছেন ঢাকি বাচ্চু মিয়ার তিন সদস্যের দল।

কথা হয় ঢাকি দলের প্রধান বাচ্চু মিয়ার সঙ্গে। এ প্রতিনিধিকে তিনি জানান, তার বাড়ি গৌরীপুর পৌর শহরের বাদ্যকর পাড়ায়। তার বাবার নাম তৈয়ব আলী পাগলা। চার ভাই, এক বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। তার বাবা গৌরীপুরের জমিদার বাড়ির গান-বাজনার আসরে বাদ্যযন্ত্র ও বাঁশি বাজাতেন। ছোট বেলায় বাচ্চু ও তার ভাই খলিল বাবার কাছ থেকেই এসব বিষয়ে তালিম নেয়। জীবিকার তাগিদে স্বাধীনতার কয়েক বছর আগে থেকেই তারা দুই ভাই বাবার সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্র বাজাতে যেতেন। দুই যুগ আগে তার বাবার মৃত্যুর হলেও বাচ্চু ও খলিল এখনো বাবার পেশাটাকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে আছেন। বাচ্চুর স্ত্রী ফিরোজা বেগম গৃহিণী। সংসারে তাদের আরিফ ও আরমান নামে দুই ছেলে রয়েছে। এই দুই ছেলেও বাচ্চুর সঙ্গে থেকে এই পেশায় যুক্ত হয়েছে। চলতি দুর্গোৎসবে পৌর শহরের মধ্যবাজার পূজা ম-পে ১৮ হাজার টাকায় তিন সদস্যের দল নিয়ে ঢাক বাজানোর কাজ নিয়েছন বাচ্চু। এই দলে রয়েছে তার ছেলে আরিফ ও তার সহযোগী মোস্তাকিম।

বাচ্চু আরো জানান, দুর্গাপূজার ছুটিতে যখন মানুষ কর্মস্থল থেকে ঘরে ফেরেন, তখনই ঢাক বাজানোর জন্য ঘর ছাড়তে হয় ঢাকিদের। বায়নার দিন থেকে বিসর্জনের দিন পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্ন ম-পে ঢাক বাজান ঢাকিরা। সারা বছর ছোটখাটো পূজা ও বিয়ের অনুষ্ঠানে ঢাক বাজালেও বড় রোজগারটুকু এই দুর্গোৎসবের সময়ই হয়। আক্ষেপ নিয়ে বাচ্চু বলেন, আধুনিক সাউন্ড সিস্টেম আসার কারণে ঢাকিদের আগের মতো কদর নেই। শুধু হিন্দু ধর্মের পূজা, বিয়ে ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানেই ঢাক-ঢোল বাজানো হয়। বলতে গেলে বিলুপ্ত প্রায় এই পেশাটা হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাই বাঁচিয়ে রেখেছেন। এরই মধ্যেই কথা হয় দলের অপর দুই সদস্য আরিফ ও মোস্তাকিমের সঙ্গে। এ প্রতিনিধিকে আরিফ বলে বলেন, ‘ঢাক- ঢোল বাজিয়ে আমাদের জীবন চলে। কোনো মাসে ৪-৫ টা কাজ পাই। তখন সংসার ভালো চলে। আবার কোনো মাসে কাজই পাই না, তখন খুব কষ্ট করতে হয়।

দলের অপর সদস্য মোস্তাকিম বলেন, ‘দিন দিন ঢাকের বাজনার কদর কমে যাচ্ছে। এখন কেবল পূজার অনুষঙ্গ হিসেবে ঢাক টিকে রয়েছে। আর আমাদের তো কেউ শিল্পী বলে মনেই করে না। তবে প্রতিদিন কাজ না থাকায় পেটের দায়ে অন্য কাজ করতে হয় সারা বছর।’

জানা গেছে একযুগ আগে বাদ্যকর পাড়ার অর্ধশতাধিক পরিবার ঢাক-ঢোল ও বাদ্যযন্ত্র বাজানোর পেশায় জড়িত ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন দুই ভাই বাচ্চু ও খলিলের পরিবারই এখন পেশাটাকে এই অঞ্চলে বাঁচিয়ে রেখেছে। এরমধ্যে বিকল্প আয়ের জন্য বাচ্চু তার দুই ছেলেকে নিয়ে এক ব্যান্ড পার্টি করেছে। স্থানীয় বিভিন্ন পূজা, বিয়ে, সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠান, গানের আসর, যাত্রাপালা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাজান তারা। সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানে বাজিয়ে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা পান। তবে হিন্দু বিয়ে হলে ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা পান তারা। ঢাকি বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘ছোট বেলা থেকেই ঢাক-ঢোল নিয়ে আছি। অন্য কোনো কাজ শিখিনি। ঢাক বাজলেই আমরা বাঁচি। দুই যুগের বেশি সময় ধরে দুর্গাপূজায় ঢাক বাজাই। ঢাকের বাজনায় সবাই মেতে ওঠেন। কিন্তু আমাদের কথা ভাবে কে?। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা ঢাকের বাজনার প্রসার চাই। চাই সরকারে পৃষ্ঠপোষকতা।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close