বদরুল আলম মজুমদার

  ২৬ মে, ২০২৩

গাজীপুর সিটি নির্বাচনে নৌকার পরাজয়

জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতির ময়দানে নতুন সংকেত 

ছবি : সংগৃহীত

বহুল আলোচিত গাজীপুর সিটি নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেছেন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন। আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী পোড় খাওয়া রাজনীতিক অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে হারিয়ে দেন একজন সাদামাটা গৃহিণী। জাহাঙ্গীর আলম তার মাকে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে পাস করিয়ে আনার মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনায় আসেন। নিজে প্রার্থী না হয়েও যেভাবে আওয়ামী লীগের মতো দলের শক্তিশালী একটি ইউনিট দ্বিতীয় গোপালগঞ্জখ্যাত গাজীপুরে নৌকার প্রার্থীকে পরাজিত করেন, তা বেশ গুরুত্ব পেয়েছে জাতীয় রাজনীতিতে।

গাজীপুরে আওয়ামী লীগের এই পরাজয়কে অনেকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে বর্তমান সরকার প্রতিশ্রুত অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে গাজীপুরের ফল সরকারি দলের জন্য বড় ধরনের বার্তা। অন্যদিকে গাজীপুরের নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ায় সরকারবিরোধী দলগুলোর জন্যও একটি উদাহরণ তৈরি করল নির্বাচন কমিশন। আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন, বর্তমান সরকারের অধীনে যে ভালো নির্বাচন হতে পারে তার জলজ্যন্ত প্রমাণ হলো এটি। তাই বৃহস্পতিবার (২৫ মে) অনুষ্ঠিত গাজীপুরের সিটি ভোট আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে বড় একটি উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করল সরকার ও নির্বাচন কমিশন। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মার্কিন নতুন ভিসানীতি প্রকাশ হওয়ায় দেশে আগামী নির্বাচনের আগে ভোট ও রাজনৈতিক দৃশ্যপটে কিছু পরিবর্তন আসবে। গাজীপুরের নির্বাচনে সেরকম একটি প্রভাব পড়েছে বলে মনে হয়।

নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও তাদের ভোটও নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে, সেটা হিসেব করছেন কেউ কেউ। নিজ দলের দুই প্রার্থীর এ লড়াইকে আওয়ামী লীগ নিজ দলের জন্য সতর্ক বার্তা হিসেবে দেখলেও কোনোভাবেই বিরোধী দল বিএনপির জন্য ভালো খবর হিসেবে দেখছেন না। অন্যদিকে বিএনপি নেতারা মনে করছেন, বর্তমান সরকারের জনপ্রিয়তা নেই, মানুষ তাদের ওপর বিরক্ত তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ফলাফলে।

এদিকে গাজীপুরে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, গাজীপুরের সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, বর্তমান সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব। শুক্রবার (২৬ মে) বিকেলে ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের আওয়ামী কার্যালয়ের সামনে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ আয়োজিত সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, দেশের একটি মহল দিন-রাত শেখ হাসিনার দুর্নাম করে বেড়ায়। তারা শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দেয়। শেখ হাসিনা বলেছেন, সব সহ্য করতে।

গাজীপুরে নৌকার পরাজয় নিয়ে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনের সমন্বয়ক টিমের সদস্য সচিব মির্জা আজম। তিনি বলেন, জয়-পরাজয় হতেই পারে। তবে গাজীপুর সিটিতে জাহাঙ্গীর আগে মেয়র থাকায় নির্বাচনের অনেক কিছুই তিনি জানেন যা তার মায়ের জন্য কাজে লাগিয়েছেন। সেখানে আমাদের ওয়ার্ড পর্যায়ে অর্থাৎ তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে জাহাঙ্গীরের যোগাযোগটা ছিল বেশি। এছাড়া বিএনপি-জামায়াত, হেফাজত ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলো মিলে নৌকার বিপক্ষে কাজ করেছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এমনটা হতে পারে।

আওয়ামী লীগের সদস্য ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনে দলীয় টিমের সদস্য নির্মল কুমার চ্যাটার্জি বলেন, সেখানে জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিল, তাই ওয়ার্ল্ড ও থানার কমিটিগুলো তার অনুসারীরাই বেশি। স্বাধীনতা বিরোধীরাও নৌকার বিপক্ষে কাজ করেছে। কিন্তু গাজীপুর সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে এ সরকারের অধীনে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রমাণিত হয়েছে।

এদিকে বিএনপি গাজীপুর সিটি নির্বাচন নিয়ে এখনো তেমন কথা-বার্তা বলছে না। দলটি শুরু থেকেই এই সরকারের অধীনে নির্বাচন বর্জন করে আসছে। তাই এই নির্বাচনের জয় পরাজয় নিয়ে তাদের তেমন বক্তব্যও নেই। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রতিবেদককে বলেন, গাজীপুরের নির্বাচনে কী হলো না হলো সেটা নিয়ে বিএনপির কোনো আগ্রহ নেই। নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থা সরকারের পকেটে, তারা চাইলে সুষ্ঠু হবে, না চাইলে হবে না, এটা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। মার্কিন নতুন ভিসানীতি নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলছে কি না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন এটা বলার সময় এখনো আসেনি।

তবে রাজনৈতিক ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, মার্কিন নতুন ভিসানীতি গাজীপুরের নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে। প্রতিবেদককে তিনি বলেন, নির্বাচনের এক দিন আগে মার্কিন ভিসানীতির ঘোষণা আসে। সেটি গাজীপুরের নির্বাচনে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলছে বলে আমি মনে করি। কারণ, মার্কিন সরকারের নতুন ভিসানীতি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মজবুত করার জন্যই দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে গাজীপুরের প্রবীণ রাজনীতিবিদ ফজলে হোসেন বলেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা অবশ্যই একটা দলের জন্য দেশের জন্য ক্ষতিকর। নির্বাচন নিয়ে যেহেতু কথা উঠেছে এর এক দিন পরেই সরকার প্রমাণ দিল তাদের অধীনে উদাহরণ হওয়ার মতো ভোট হওয়া সম্ভব। গাজীপুরে এত সুন্দর নির্বাচন আগে হয়নি।

তবে, কারচুপি, জবরদস্তি ও বল প্রয়োগ ছাড়া কোনো নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের জয়লাভ করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জায়েদা খাতুন জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ায় অভিনন্দন জানিয়ে এক বিবৃতিতে তিনি এ মন্তব্য করেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, গত ১৫ বছর ধরে অপশাসন এবং বাগাড়ম্বর আওয়ামী লীগকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। ভোটাধিকারের ন্যূনতম সুযোগ থাকলে যে কারো সঙ্গে নির্বাচনী চ্যালেঞ্জে আওয়ামী লীগ কত সহজে পরাজিত হয় তা গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে। এ কঠিন বাস্তবতা ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নতা আওয়ামী লীগকে মেনে নিতে হবে।

এ দিকে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে পরাজিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান বলেছেন, আমি পরাজয় মেনে নিয়েছি। কেউ সহযোগিতা চাইলে বিবেচনা করা হবে। ছেলে জাহাঙ্গীর আলমের ‘ডামি প্রার্থী’ থেকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নারী মেয়র জায়েদা খাতুন। নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি বলেছেন, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে। আমি খুব খুশি। এ জয় আমি প্রধানমন্ত্রী ও গাজীপুরের জনগণকে উপহার দিলাম। শিগগিরই আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করব।

পিডিএসও/এমএ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জাতীয় পর্যায়,রাজনীতির ময়দান,নতুন সংকেত
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close