গাজী শাহনেওয়াজ
স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত
দিব্যি চলছে বেচাবিক্রি, নজরদারি নেই পাড়া-মহল্লায়
মিরপুর পল্লবী কালশীর মুদি ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার। প্রতিদিনকার মতো বুধ ও বৃহস্পতিবার নিয়মমতন দোকান খুলেছেন বলে জানান তিনি। প্রাণসংহারী নভেল করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সরকারের ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধ মানায় কে সাধারণ মানুষকে বাধ্য করবে—এ নিয়ে তার মধ্যে রয়েছে নানা সংশয়-প্রশ্ন।
প্রতিদিনের সংবাদকে আবদুল জব্বার বলেন, শুনেছি লকডাউনে সবাইর নাকি নানা সমস্যা হচ্ছে। আবার দেখছি সবাই বাইরে যাচ্ছে যার যার প্রয়োজনে। আবার তারাই রাস্তা পাড়া-মহল্লা এবং মুদি ও কাঁচাবাজারে ভিড় দেখে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করছে। উল্টো এ প্রতিবেদকের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে এই মুদি দোকানি বলেন, সরকার যাবে কোথায় আপনি বলেন?
রাজধানীর আরামবাগের বাসিন্দা কামরুন নাহার। সরকারের স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার চাকরি করেন। সরকারের ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধ কেমনভাবে উপভোগ করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিকালে আমার জামাই (স্বামী) আরামসে গিয়া হালিম আর জিলাপি কিন্না বাসায় আনছে। তারে কেউ কিছুই বলে নাই। উল্টো পুলিশ যত্ন কইরা হালিমের লাইনে দাঁড় করাইয়া দিসে।
আজিমপুরে থাকেন পলাশ কুন্ডু। কাজের প্রয়োজনে সকালে বাসা থেকে বের হন তিনি। বিকালে বাসায় ফেরার আগে রাস্তায় কোথাও তাকে নিরাপত্তারক্ষীদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়নি বলে জানান কুন্ডু। বলেন, এ কারণে পকেটে থাকা মুভমেন্ট পাসটি ব্যবহার হয়নি।
কারওয়ানবাজার এলাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্টাফ মাসুদ রায়হান বলেন, ঢালাওভাবে বলবো না, প্রধান সড়কগুলোতে আজ পুলিশ বেশ সর্তক ছিল। রাস্তায় মানুষ দেখা গেছে কম। নাজমুল হাসান সাগর বলেন, দুপুর ১২টার পরেই সব উঠে যায় কড়াকড়ি। এ প্রশ্ন শুধু নাজমুলের একা নয়, পাড়া-মহল্লায় দোকানপাট সবখোলা। সাধারণ দিনের মতন সরকারের কঠোর বিধিনিষেধ সত্বেও বন্ধ হয়নি বেচাবিক্রি। পুলিশ প্রশাসনের কোন নজরদারি চোখে পড়েনি। ধর্মীয় উপসানলয়ে সাধারণ দিনের চেয়ে অতিরিক্ত মুসল্লির উসস্থিতি ঘটছে। পাড়া-মহল্লার মতন এসব উপসানলয়গুলোতে দেখা যাচ্ছে পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত। উল্টো ধর্ম মন্ত্রণালয়ের জারি প্রজ্ঞাপনের কঠোর সমালোচনা করতে দেখা যাচ্ছে কাউকে কাউকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন মুসল্লি বলেন, গামেন্টমস খোলা রেখে ধর্মীয় উপসনালয় মুসল্লি শূন্য করার এ সরকারের নতুন কৌশল। লক্ষ্য হেফাজত আন্দোলন ঠেকানো এবং তাদের নিচিহ্ন করার লকডাউন।
জানতে চাইলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. নুরুজ্জামান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, সরকার একটি বৃহৎ ক্ষেত্র। সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্ভব না। কারণ সামগ্রিক অর্থনীতি ও কূটনীতিক পলিসি অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয়। সেদিক থেকে লকডাউন না বলে করোনাকালিন দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, এটা সামগ্রিক বিবেচনায় যৌক্তিক। তবে এই বিধিনিষেধের মধ্যেও মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানায় কোন সচেতনতা দেখতে পারছি না। প্রতিদিন দেশে মৃত্যুর সংখ্যা রেডিকেলীভাবে বাড়ছে। কিন্তু মানুষ নিজের সুস্থতার কথা ভেবে মুখে মাস্ক পড়ছে না, এটা দুংখজনক।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক জাকির হোসেন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, প্রধান সড়কে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ কমবে এমনটাতো নয়। কঠোর বিধিনিষেধ আরোপতো পাড়া-মহল্লায়ও থাকতে হবে। কিন্তু এখানে তো কোন প্রশাসনের নজরদারির খবর পারছি না। যথারীতি হাট-বাজার, দোকানপাট নিত্যদিনকার মতন খোলা আছে। গাদাগাদি করে মানুষ পণ্য কিনছে ও বেচাবিক্রি চলছে দেদারসে। প্রধান সড়কের পাশাপাশি পাড়া-মহল্লায় দোকানপাট খোলা ও বন্ধে বিধিনিষেধ সঠিকভাবে প্রতিপালন সম্ভব না হয় তাহলে করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি হ্রাসে সরকারের নওয়া এই পদক্ষেপও আগের শিথিল লকডাউনের মতন অকার্যকর হবে। এতে রাষ্ট্রের ক্ষতির পাশাপাশি সাধারণ মানুষের ক্ষতি সমানভাবেই হবে। সংক্রমণ কমানোর ফলাফল দাঁড়াবে শূন্যতে। স্বাস্থ্যবিধি মানায় সরকারের নিয়োজিত বাহিনীকে কঠোর হতে হবে, প্রয়োজন জরিমানা করে সাধারণ মানুষকে ঘরে থাকতে বাধ্য করতে হবে।
মানুষের মেধা-বিকাশের উৎকর্ষ সাধনে কাজ করা গবেষক আবদুর রাজ্জাক প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, মানুষ ধরেই নিয়েছে সংক্রমিত রোগ নয় প্রাণঘাতী কোভিড। যদি এটা ছোঁয়াছে কোন রোগ হতো থাকলে বিশাল জনগোষ্ঠীর এই দেশে লাশের মিছিল দেখা যেত। এই সব নানা নিজস্ব চিন্তার জায়গা থেকে স্বাস্থ্যবিধি মানায় উৎসাহ দেখাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। ফলে এটা সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। মানুষ নিজের সুরক্ষার কথা ভেবে যখন স্বাস্থ্যবিধি মানা শুরু করবে, সরকারের উদ্যোগ ছাড়াই কোভিড সংক্রমণ হ্রাস পেতে শুরু করবে বলে আশা করা যায়।
পিডিএসও/হেলাল