শফিক আহমেদ ভুইয়া
বুয়েটে ধর্মকে ব্যবহার করে গণ-উন্মাদনা তৈরির সংস্কৃতির দায় কীভাবে এড়াবেন?
ছাত্র রাজনীতির বুনিয়াদী সংজ্ঞা বা ধারণায় একটি সংগঠনের যা যা করার কথা, সেরকম উল্লেখযোগ্য কোনো গঠনমূলক কাজে বর্তমান ছাত্রসংগঠনগুলোকে দেখা যায়নি। মহাকালের খাতায় যে বছরগুলো চলে গেছে, সেখানে আমরা বরং বারবার তাদের পেয়েছি মধ্যমা সঞ্চালনের ক্রিয়াবিশেষ্যের প্রতিশব্দ হিসেবে।
অন্যদিকে ছাত্ররাজনীতিকে দুইভাবে সংজ্ঞায়ন করা যায়। প্রথমত, ছাত্ররাজনীতি বলতে ছাত্রদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা তোলা, এজেন্ডা হিসেবে গ্রহণ করানো এবং সেই এজেন্ডার পক্ষে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে কর্তৃপক্ষকে চাপ প্রয়োগ করার জন্য পরিচালিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বোঝায়। দ্বিতীয়ত, জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় কোন রাজনৈতিক দলের ছাত্র শাখা হিসেবে ছাত্রদের মাঝে সেই দলের সমর্থন তৈরি করা এবং সেই দলের স্বার্থে ছাত্রদের ব্যবহার করাকে ছাত্ররাজনীতি বলা হয়। ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক সমস্যা নিরসনে লিডারশীপ গড়ে ওঠে। ফলশ্রুতিতে দেশের আগামীর গতিধারা কোন দিকে ধাবিত হবে সেটা সহজে অনুমান করা যায়। ছাত্র রাজনীতির বুনিয়াদী সংজ্ঞা বা ধারনায় একটি সংগঠনের যা যা করার কথা, সেরকম উল্লেখযোগ্য কোনো গঠনমূলক কাজে বর্তমান ছাত্রসংগঠনগুলোকে দেখা যাচ্ছে না। এখন দেশে একটা বিপদজনক রাজনীতিবিমুখ প্রজন্ম বেড়ে উঠছে৷ জিজ্ঞেস করলেই তারা স্মার্টলি জবাব দেয়, আমি রাজনীতি পছন্দ করি না, আই হেইট পলিটিক্স! অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনসহ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রদের বিশেষ করে ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা সবার জানা৷ ছাত্র রাজনীতির এই গৌরবের ধারা স্বাধীন বাংলাদেশেও ছিল৷ কিন্তু এখন সেখানে উলটো হাওয়া৷ সবচে বেহাল দশা ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। বাংলাদেশের আরেকটা ছাত্ররাজনীতির ধারা হল নিষিদ্ধ আবহে রাজনীতি চলমান রাখা। এতে পারিপার্শ্বিকতার প্রাসঙ্গিকতা কেবল টানে ধর্ম কে ঘিরে । কখনো অন্তরালে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে নিজেদের শানিত করছে আবার কখনো ধর্মীয় প্রোডাক্টিভ আলোচনার নামে ধর্মীয় ছাত্ররাজনীতি বা সাম্প্রদায়িক চেতনা জাগিয়ে তুলতে মরিয়া হয়ে কাজ করছে ইসলামি ছাত্রশিবির বা হিজবুল্লাহর মত ধর্মীয় ছাত্রসংগঠন গুলো। কিছুদিন পূর্বে সুনামগঞ্জে একটি বুট থেকে বুয়েটের একাধিক শিক্ষার্থী কে আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল সরকার বিরোধী কার্যক্রমে জড়িত ছিল তারা এবং তারা সবাই ধর্মীয় ছাত্রসংগঠনের সক্রিয় সদস্য। তখন প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন ছাড়া বাকিরা কার্যত নীরব ছিল কৌশলগত কারণে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য হচ্ছে, ধর্ম বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় ধর্মীয় অনুভূতিকে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্যই সবচেয়ে বেশি কাজে লাগানো হয়। আর বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধকরণ নিয়ে যারা বরাবরই সবচেয়ে বেশি সরব তাদের খোঁজ নিয়ে দেখেন প্রথম সারির সবাই ধর্মীয় ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত।আর ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয় কে কাজে লাগিয়ে এতে কিছু সাধারণ শিক্ষার্থী সম্পৃক্ত করে পুরো ঘটনাকে সাধারণ শিক্ষার্থী ট্যাগ লাগিয়ে তাদের ফায়দা তুলে নিচ্ছে তারা। যে কারণে এর অনুষঙ্গ হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে সাম্প্রদায়িক প্রবণতাও তৈরি হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক প্রবণতা যেখানেই দৃশ্যমান হচ্ছে, সেখানেই নেপথ্যে এই শিবির হিজবুল্লার মতো সংগঠনগুলোর যোগসূত্রের অভিযোগ মেলে। আর কিছু সাধারণ শিক্ষার্থীদের মৌনতার নীতি অনুসরণ করে, তা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অপ্রীতিকর ঘটনা। আর এ অপ্রীতিকর ঘটনার মূল কারণ হচ্ছে একটি সংগঠনের যা যা করার কথা, সেরকম উল্লেখযোগ্য কোনো গঠনমূলক কাজে বর্তমান ছাত্রসংগঠনগুলোকে দেখা যাচ্ছে না। পলিসিতে দূর্বলতা দৃশ্যমান তবে তার মানে এই নয় যে, মাথা ব্যাথা হলে মাথাটাই কেটে ফেলা! নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য জন্য পলিসি পরিবর্তন,পরিমার্জন ও পরিশুদ্ধ করা যেতে পারে। নয়ত হিজবুত তাহরির, ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ বিভিন্ন উগ্র ও মৌলবাদী ছাত্রসংগঠন যেভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে তাতে সাম্প্রদায়িক আস্তানায় পরিনত হবে।এই সাম্প্রদায়িকতা ক্রমশ দানবীয় রূপ নিচ্ছে। বুয়েটে এমন পরিস্থিতিতে যা হচ্ছে তা যদি চলমান থাকে তাহলে যে মেধাবী প্রজন্মের আশা আমরা করছি তা কেবল একাডেমিক পর্যায়ে লিপিবদ্ধ থাকবে জাতিগত উন্মেষ ঘটার সম্ভাবনা কার্যত কম। বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে রেটোরিকাল ফিউশন প্যারাডাইম থিসিসে উন্মাদ হয়ে উঠবে। সংহতিমূলক প্যারাডাইম মূলত পাকিস্তান রাষ্ট্রগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল।যা বাংলাদেশ সৃষ্টির সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। সেখানে ব্রিটিশ উপনিবেশ আধিপত্যবাদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য উপমহাদেশের অঞ্চলগত ও ভাষাগত বিভক্ত মুসলমানদের একীভূত করার জন্য প্রধানতম উপায় ছিল ধর্ম। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের গঠনের পর যে প্যারাডাইম যেখানে সাংস্কৃতিক দূরত্ব প্রধান হয়ে ওঠে, যা মূলত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বঞ্চনা থেকে। এর ফলে রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্কটা ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে। স্রেফ বলতে গেলে বুয়েটে যা চর্চা হচ্ছে তা হল আমাদের সাংস্কৃতিক জাগরণ নিভিয়ে ফেলার মঞ্চায়ন। সেখানে ৫২, ৬২, ৬৬ ও ৭১ টুনকো ফিকে সাবজেক্টিভ থিংক। দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে থাকা যে প্যারাডাইম কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে বলেছিলেন তেইশ বৎসের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। সে প্যারাডাইমকে মূলোৎপাটন করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন "আর দাবায়ে রাখতে পারবে না, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুলো" সে প্যারাডাইমকেই পুনর্জীবিত করতে চাচ্ছে বুয়েট। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিক্ষা, জ্ঞান, সংস্কৃতির গুরুত্ব বাড়াতে হবে।
লেখক : পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিটস, সাবেক গণযোগাযোগ ও উন্নয়নবিষয়ক উপসম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ [email protected]