অধ্যাপক ডা. মো. শারফুিদ্দন আহমেদ
স্মরণ
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া
অত্যন্ত সাটামাটা জীবনের অধিকারী, বর্ণাঢ্য শিক্ষা, কর্মময় জীবনের অধিকারী ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পপন্ন পরমাণু বিজ্ঞানী প্রয়াত ড. ওয়াজেদ মিয়া তার সমগ্র জীবনে মেধা, মনন ও সৃজনশীলতা দিয়ে দেশ, জাতি ও জনগণের কল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। ক্ষমতার অনেক কাছাকাছি থেকেও কখনো ক্ষমতার দাপট না দেখিয়ে বরং খুব সাদামাটা একটা জীবন কাটাতেই পছন্দ করতেন। এটাই ছিল তার জীবনের অন্যতম বড় একটি দিক। মেধাবী এই মানুষটি নীরবে, নিভৃতে নিরলসভাবে গবেষণায় থেকে দেশের উন্নয়নের জন্য আমৃত্যু কাজ করে গেছেন।
তার ডাক নাম সুধা মিয়া। তিনি ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দ রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার ফতেহপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আব্দুল কাদের মিয়া এবং মাতা ময়েজুন্নেসা। তিন বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি সর্ব কনিষ্ঠ। তিনি চককরিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। মানসম্মত লেখাপড়ার জন্য তাকে রংপুর জিলা স্কুলে ভর্তি করানো হয়।
১৯৫৬ সালে রংপুর জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পর ১৯৫৮ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন এবং ১৯৬২ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। ১৯৬৭ সালে লন্ডনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে পড়ার সময় থেকেই ধীরে ধীরে সংশ্লিষ্ট হতে শুরু করেন রাজনীতির সাথে। ১৯৬১ সালে ফজলুল হক হলের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ থেকে সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে এমএসসি পাস করার পর ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে আণবিক শক্তি কমিশনে চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৬৭ সালে লন্ডনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভের পর দেশে ফেরার পর একই বছর ১৭ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে বিয়ে করেন। স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের কারণে তিনি কিছুদিন কারাবরণ করেন। ১৯৭১ সালে এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং এর আগে ও পরের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তার উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। ড. ওয়াজেদ মিয়া আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৯৯ সালে অবসর নেন।
২০০৯ সালের ৯ মে বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে দীর্ঘদিন কিডনির সমস্যাসহ হৃদরোগ ও শ্বাসকষ্টে ভুগে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ৬৭ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। এম এ ওয়াজেদ মিয়া স্নাতক পর্যায়ের বিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্য দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। ইংরেজিতে লেখা গ্রন্থদ্বয়ের নাম Fundamentals of Thermodynamics এবং Fundamentals of Electromagnatics। তার অন্যতম গ্রন্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। ৪৬৪ পৃষ্ঠার সুপরিসর এই গ্রন্থে বাংলাদেশের বহু রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। তার আরেকটি গ্রন্থের নাম বাংলাদেশের রাজনীতি ও সরকারের চালচিত্র যা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড কর্তৃক ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশের রংপুরে অবস্থিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রাণপুরুষ এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী হিসেবে তার স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে ড. ওয়াজেদ রিসার্চ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বাংলাদেশের ঢাকায় অবস্থিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিজ্ঞান গবেষণার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ বিজ্ঞানাগার, এম এ ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নাটোরে প্রস্তাবিত ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরে ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ তার নামে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
তিনি বাংলাদেশ জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের উপদেষ্টা এবং ঢাকার বৃহত্তম রংপুর কল্যাণ সমিতি, উত্তরবঙ্গ জনকল্যাণ সমিতি, রাজশাহী বিভাগীয় উন্নয়ন ফোরাম, বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদ এবং রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার মির্জাপুর বছির উদ্দিন মহাবিদ্যালয়ের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন।
বিজ্ঞান নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন ওয়াজেদ মিয়া। প্রথিতযশা পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার স্বপ্ন ছিল, বাংলাদেশের রূপপুরে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপিত হবে। তার স্ত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আজ বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, বিশ্বমাঝে বাংলাদেশ বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ একটি দেশ হিসেবে পরিচিতি পাবে। সে সব স্বপ্ন বাস্তবায়নে তার নিরলস পরিশ্রম অব্যাহত রেখেছিলেন আমৃত্যু।
ড. ওয়াজেদ মিয়ার ক্ষমতার মোহ না থাকলেও তিনি রাজনীতিবিমুখ ছিলেন না। স্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হয়ে সব বাধাবিপত্তি জয় করে দেশে ফিরতে চাইলে তাতে সমর্থন ও পূর্ণ সহযোগিতা করেছেন স্বামী ওয়াজেদ মিয়া। নিজের দুই সন্তান যথাক্রমে সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে আদর্শ শিক্ষা দিয়ে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। যার প্রমাণ এরই মধ্যে আমরা পাচ্ছি। পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের ডিজিটাল বাংলাদেশ স্বপ্নের আলোতে আলোকিত হচ্ছে সমগ্র বাংলাদেশ। আর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল সমাজের অবহেলিত প্রতিবন্ধী ও পিছিয়ে পড়া নারীদের নিয়ে কাজ করে তাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত।
ড. ওয়াজেদ মিয়া ব্যক্তিজীবনে যেমন একজন সফল ও আদর্শ মানুষ ছিলেন ঠিক তেমনিভাবে স্বামী এবং পিতা হিসেবে তিনি সফল ও বলতে হবে গর্বিত ছিলেন। একজন মানুষ হিসেবে তার বরেণ্য কর্মকাণ্ড ও নির্মোহ জীবনযাপন জাতির কাছে তাকে করেছে মহিমান্বিত।
লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা
পিডিএস/মীর