তামান্না তাসমিয়া তুয়া
মতামত
নতুন প্রজন্মের চলচ্চিত্র ‘ড. নূরুন নবী: আজীবন মুক্তিযোদ্ধা’
একুশে পদকপ্রাপ্ত, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী ও লেখক ড. নূরুন নবী। তার বর্ণাঢ্য ও সংগ্রামমুখর অনুকরণীয় জীবনের চিত্র নিয়ে ‘ড. নূরুন নবী: আজীবন মুক্তিযোদ্ধা’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন তরুণ নির্মাতা নাদিম ইকবাল। নির্মাতা তার উদ্যম ও দক্ষতার ছাপ রেখেছেন নির্মাণশৈলীতে। ড. নূরুন নবীর লেখা সাড়া জাগানো বই ‘বুলেট অব সেভেন্টি ওয়ান: আ ফ্রিডম ফাইটার্স স্টোরি’ অবলম্বনে নির্মিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটির দৈর্ঘ্য ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট। চলচ্চিত্রে বাংলাদেশের ৫২ বছরের গল্প ফ্রেমবন্দি করেছেন নির্মাতা নাদিম ইকবাল। বাংলাদেশের গৌরবময় অর্জনের কালজয়ী দৃষ্টান্ত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে সংগ্রাম করে এ বিজয় অর্জন করেছিলেন। এরপর যারা আত্মনিয়োগ করেছেন দেশ গড়ার কাজে ড. নূরুন নবী তাদের অন্যতম।
ড. নূরুন নবীর জীবনের গল্পে প্রসঙ্গক্রমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার অংশগ্রহণের গল্প যেমন এসেছে, তেমনি তুলে ধরা হয়েছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়, যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের চিত্র, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর বাংলাদেশ যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংকটে নিমজ্জিত হয়েছিল এবং সে সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এ দেশের মানুষ নতুন করে সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল, উজ্জীবিত হয়েছিল নতুন প্রাণশক্তিতে। যে শক্তির জোগান দিয়েছিল জাহানারা ইমাম, সে শক্তির উৎসে ছিলেন ড. নূরুন নবী। প্রবাসে থেকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দেওয়ার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে চলচ্চিত্রটিতে। জাহানারা ইমামের সঙ্গে ড. নূরুন নবী ঘাতক দালাল নির্মূল আন্দোলনে যুক্ত হয়ে আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে বাংলাদেশের ইতিবাচক দিক তুলে ধরেছেন। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির ওপর মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির অন্যায় আস্ফালনের প্রতিবাদ করেছেন কঠোর ভাষায়। এ প্রতিবাদ তিনি করেছেন কখনো মুখের ভাষায়, বক্তৃতায়, লেখায় আবার কখনো রাজপথের মিছিলে। ‘ড. নূরুন নবী, আজীবন মুক্তিযোদ্ধা’ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটিতে এসব বিষয় উঠে এসেছে দালিলিক প্রমাণসহ।
ড. নূরুন নবীর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান ও বীরত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেলদের সঙ্গে সুসম্পর্ক ও যোগাযোগ রেখে ভারত থেকে বাংলাদেশে যুদ্ধের যাবতীয় অস্ত্র সংগ্রহ ও বহন করে নিয়ে আসা। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি তিনবার ভারতে গিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করার জন্য। সে সময় তিনি যে পথ ধরে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করেছিলেন, যে পথ ধরে গিয়েছিলেন এবং ভারতের যে অঞ্চল থেকে অস্ত্র গোলাবারুদ সংগ্রহ করে নদী পথে এসেছিলেন বাংলাদেশে, সে পথের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্রটিতে দেখানো হয়েছে ড. নূরুন নবীর জীবন সংগ্রাম, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আদর্শিক সংগ্রাম, সংঘাত, রক্তক্ষরণ, সাংস্কৃতিক বিপর্যয় এবং পুনরায় সংগ্রামের ফলে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংকট থেকে উত্তরণের দৃশ্যপট। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউয়ে ড. নূরুন নবীকে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর ব্রেইন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
প্রিমিয়ার শোতে আসা দর্শকরা বারবার ফিরে গেছেন অতীতের বাংলাদেশে। নতুন প্রজন্মের দর্শকরা চোখের সামনে যেন মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন। এ ধরনের চলচ্চিত্র যত বেশি দেখানো হবে এবং নির্মাণ করা হবে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ও নিজের দেশ সম্পর্কে তত বেশি সচেতন হবে। চলচ্চিত্রের প্রথম প্রিমিয়ার শোতে আসা দর্শকদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দর্শক ছিলেন এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। যারা সবাই স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। দর্শক সারিতে বসার জায়গা না পেয়ে অনেকেই ওয়াকওয়েতে বসে আর দাঁড়িয়ে পুরো চলচ্চিত্রটি উপভোগ করেছেন। শো শুরুর প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মন্ত্রমুগ্ধের সব দর্শক সিনেমা দেখেছেন। সিনেমার কিছু কিছু অংশ দর্শকদের কাঁদিয়েছে। এই সিনেমা তৈরির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি, দেশ গঠনের পেছনের সংগ্রাম দেখেননি তাদের সে সম্পর্কে জানানো। যারা আগামীর বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে, দেশ পরিচালনা করবে, দেশের সুনাগরিক হবে তাদের মধ্যে দেশপ্রেম ও দেশের স্বার্থে নিজেকে নিয়োজিত করার মূল্যবোধ জাগ্রত করা।
সারা দেশের স্কুল-কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চলচ্চিত্রটির প্রদর্শনীর আয়োজন করা দরকার। সরকারি সংস্থাগুলো এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবে বলে আশা করছি।