মাহমুদুল হক আনসারী

  ০১ জানুয়ারি, ২০২৪

নতুন বছরে নাগরিক প্রত্যাশা 

ছবি : সংগৃহীত

বলতে বলতে শেষ হতে যাচ্ছে একটি বছর। নতুন আরেকটি বছর শুরু হতে যাচ্ছে। বিগত বছরের অনেক কথা, ঘটনা, ইতিহাস, ভালো-মন্দ ঘটে যাওয়া অনেক কিছু ছিল স্মৃতি হিসেবে। অতীত ইতিহাসের একটি বছর বাংলাদেশের জনগণের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। ইতিহাস হয়ে থাকবে নানা ঘটনার পরিসমাপ্তি। মানুষের সুখ-দুঃখ, শান্তি-অশান্তি, পারিবারিক-সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নানা ঘটনায় জর্জরিত ছিল বাঙালি জাতির জন্য ২০২৩ সাল। মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থ পাচার, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্দোলন, সংগ্রাম, মিছিল-মিটিং, অবরোধের বছর ছিল বাঙালি জাতির জন্য ২০২৩ সাল। ছাত্রদের মধ্যে হতাশা, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে নানা ধরনের টেনশন আর জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নানা স্বপ্ন তাদের জীবনে এক অস্থির সময় তৈরি করেছে ২০২৩ সাল।

রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে ২০২৩ সালে বহু ঘটনা দেশের জমিনে সংঘটিত হয়েছে। অপহরণ মামলা-হামলা, গুম, খুন হয়েছে বহু নিরীহ পরিবারের সদস্য। রাজনৈতিক কারণে ঘরবাড়ি ছাড়া, এলাকা ছাড়তে হয়েছে অনেক কর্মীকে। মামলার কারণে অনেককেই ঠিকানাবিহীন জীবনযাপন করতে শোনা যাচ্ছে। গোটা বছরটি ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্দোলন, সংগ্রাম আর জনজীবনে অস্থির একটি পরিবেশ। পরিবার থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে। প্রশাসনিক সব সেক্টরে জনভোগান্তি, হয়রানি জনগণের নিত্যসঙ্গী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেই অতীতের পড়ালেখার আদর্শিক সব সিলেবাস পরিবর্তনের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার বারোটা বেজেছে। শিক্ষার্থীরা আগেকার যুগে যেভাবে লেখাপড়া করত, পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল এখন আর বই-পুস্তকের সঙ্গে শিক্ষার্থীর সেই ভালোবাসা নেই বলা চলে। কারণ এখন আর স্কুল-বিদ্যালয়ে সেই বইপুস্তক থেকে গণিতের অঙ্ক, ইংরেজির বাক্য, গল্প তৈরি, রচনা শিক্ষার পড়ালেখা হয় না। আজকের স্কুল শিক্ষায় ছাত্রদের শেখানো হচ্ছে সংস্কৃতির নামে বিজাতীয় সংস্কৃতি। শিক্ষার নামে রান্নাবান্না তৈরির প্র্যাকটিস। আদর্শিক শিক্ষার পরিবর্তে অনৈতিক শিক্ষা। ক্রমেই এগিয়ে চলছে। পোশাক-আশাক বেশভূষার পরিবর্তন এলেও শিক্ষার মাধ্যমে আলোকিত শিক্ষার্থী আদর্শিক নাগরিক নৈতিক শিক্ষার কারিগর শিক্ষক থেকে শিক্ষার্থী পর্যন্ত ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে।

জাতীয় জীবনে নানা অবক্ষয়, দুর্নীতি, লুটপাট; রাজনীতিতে সহিংসতা, শিষ্টাচারবহির্ভূত রাজনৈতিক কালচার বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতীয়ভাবে শৃঙ্খলা পরিবার থেকে রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে ক্রমেই জাতি হারিয়ে ফেলছে। শিক্ষিত বিশিষ্টজনদের অভিমত এভাবে একটি জাতি মোটেও টিকে থাকতে পারে না। জাতির মেধা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, গবেষণা এসব বিষয়কে যদি গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রতিষ্ঠিত করা না হয়, তাহলে একটি জাতি ধ্বংস হওয়ার জন্য আর বেশি কিছু প্রয়োজন পড়ে না। ইংরেজি নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে বিদায় বছরকে মূল্যায়ন করে বলতে গেলে আমাদের জাতীয় চরিত্রের পরিবর্তন করতে হবে। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে পরিবর্তন করতে না পারলে এ জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নয়। শুধু দিন, মাস আর বছর গণনা করলে হবে না। আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে জনকল্যাণ, মানবকল্যাণ, মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার কী পর্যন্ত আমরা স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি, সেই জায়গাতে জাতীয়ভাবে জাতীয় নেতৃত্বকে হিসাব করতে হবে। শুধু উন্নয়ন, নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠার নাম শিক্ষা অগ্রগতি আর জাতীয় উন্নতি বলা চলে না। জাতীয় উন্নতির জন্য জাতীয়ভাবে নাগরিক চরিত্র, নাগরিক আদর্শ, মূল্যবোধ, দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রীয় সব ধরনের প্রতিষ্ঠানকে গড়ে তুলতে হবে।

উন্নয়নের মাধ্যমে জনগণের কল্যাণ সেটি সত্য কথা। একটি সরকার বারবার থাকলে সেই সরকার ধারাবাহিকভাবে অবকাঠামো উন্নয়ন নাগরিক সেবা জনকল্যাণমূলক কাজ করবে, সেটিই স্বাভাবিক। তবে সেসব প্রকল্প বাস্তবায়নে হাজার লাখ কোটি টাকার দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ পাচার জাতীয় অর্থনীতিকে যে পর্যায়ে তলাবিহীন করে রেখেছে, সেই জায়গায় শান্তিকামী জনগণ চুপ থাকতে পারে না।

দুর্নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতীয় নাগরিক বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংকগুলোকে আজকে অর্থশূন্য করে পথে বসানোর অবস্থা সৃষ্টি করেছে। এসব ব্যাংকের চেয়ারম্যান পরিচালক যারা জনগণের আমানত নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে না। ব্যাংকের অর্থ নানা ছলছাতুরীর মাধ্যমে লুটপাট হবে আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার চুপ করে বসে থাকবে, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোনোভাবে এসব চোখ বুঝে মেনে নেওয়া যায় না। অর্থ পাচারকারী দেশের সম্পদ লুণ্ঠনকারী সেসব দুর্নীতিবাজ রাঘববোয়ালদের অবশ্যই আইনের আওতায় এনে জনগণের অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করতে হবে।

২০২৪ সালে আগত বছরটি বাংলাদেশের জনগণের জন্য কী ভাগ্য নিয়ে আসছে, সেটি কিছুটা হলেও জনগণ বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের আকাশে শকুনের থাবা দেখতে পাচ্ছি। এ দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে একটি শক্তি বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, জনগণের চিন্তাচেতনা ও আদর্শবিরোধী ষড়যন্ত্রের থাবা বিস্তার করে রেখেছে। চতুর্দিকে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এ মুহূর্তে আগামী ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান হওয়ার কর্মসূচি বাস্তবায়নের পথে যদি কোনো ধরনের সমস্যা, বিশৃঙ্খলা, অঘটন না ঘটে; ইনশাআল্লাহ সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন হবে। সেই নির্বাচনে যারাই জয়ী হবে, তারাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে। জনগণ সেটাই প্রত্যাশা করছে। নতুন বছরে নতুন সরকার বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করবে। শিক্ষিত যুবসমাজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে। পাঠ্যপুস্তকের সব ধরনের অমীমাংসিত আপত্তিকর অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষিত স্কলারদের সঙ্গে পরামর্শ করে একটি যুগোপযোগী এ দেশের কৃষ্টি কালচার সামঞ্জস্য রেখে একটি সিলেবাস তৈরি করবে। যেই সিলেবাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নিজেকে তৈরি করতে পারবে।

যেকোনো কিছুর বিনিময়ে দুর্নীতিকে জিরো পয়েন্টে এনে বাংলাদেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি অর্জনের আয় দিয়ে এ দেশের জাতীয় উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে। ৩ লাখের অধিক শিক্ষিত গ্র্যাজুয়েট যুবকের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে পুনর্বাসন করবে। বেকারত্ব প্রতিরোধ করতে হবে। ছাত্র-যুবকদের বয়স ও সময়ের সঙ্গে তাদের সব ন্যায্য অধিকার পূরণ করতে হবে। দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ মূল্যস্ফীতি ডলার সংকট জাতীয়ভাবে সমন্বয় করে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিকে শৃঙ্খলায় আনতে হবে। সব ধরনের রাজনৈতিক নাগরিক অস্থিরতামুক্ত একটি পরিবেশ চাই। মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার, প্রশাসনিক সেক্টরে জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নতুন বছরে নতুন সরকারের কাছে মানবকল্যাণ, জনকল্যাণ, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের মাধ্যমে নাগরিক প্রত্যাশা পূরণ হোক- সেই প্রত্যাশা জনগণের।

লেখক : কলাম লেখক ও সংগঠক

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
নতুন বছর
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close