গাজী শাহনেওয়াজ

  ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

ষোড়শ সংশোধনী বিতর্কে আইনজ্ঞদের অভিমত

বিচারপতিদের সমালোচনায় অনাস্থা সৃষ্টি হতে পারে

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়ে প্রধান বিচারপতির বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া কয়েক দিন থেমে থাকার পর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রায়ের পর সংসদে প্রস্তাব গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে ফের বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে। গত বুধবার জাতীয় সংসদে আপিল বিভাগের রায়কে এখতিয়ারবহির্ভূত আখ্যা দিয়ে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের এ প্রস্তাব পাস হয়। সংসদের এই প্রস্তাবের আলোচনায় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার কঠোর সমালোচনা হয়।

এদিকে, দেশের আইনজ্ঞরা বলছেন, রায়ের পর্যবেক্ষণে সমালোচনার সুযোগ রয়েছে। কারণ, ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে দেওয়া রায়টি প্রশ্নবিদ্ধ। তবে, রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে সমালোচনার বাইরে বিচারপতিদের সম্পর্কে বেশি বেশি সমালোচনা শুরু হলে তাদের সম্পর্কে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে। একইভাবে বিচারপতি ও বিচার বিভাগ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে এখনো যে আস্থার জায়গা আছে, সেখানে চির ধরতে পারে। এ ছাড়া এ রায় নিয়ে সংসদে প্রস্তাব গ্রহণ করার মাধ্যমে সরকার আইনি পথে এগোচ্ছে সেটিও স্পষ্ট হয়েছে, যা রিভিউ আবেদনের মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে আলোচনা-সমালোচনার নিষ্পত্তি ঘটবে। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়া রায়ের ওপর গত বুধবার জাতীয় সংসদের অধিবেশনে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। এ প্রস্তাবের ওপর প্রায় পাঁচ ঘণ্টার আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতাসহ ১৮ জন মন্ত্রী-সংসদ সদস্য অংশ নেন। তাতে সবাই প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার কড়া সমালোচনা করেন। কেউ কেউ বলেছেন, প্রধান বিচারপতি একাধিকবার শপথ ভঙ্গ করেছেন। তার দুর্নীতির দালিলিক প্রমাণ আছে। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগও আনেন কেউ কেউ। আর আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আদালতের রায়কে সাংঘর্ষিক ও স্ববিরোধী আখ্যা দেন। তিনি বলেন, ‘এ রায় কোথা থেকে, কারা যেন তৈরি করে দিয়েছে, সেটা একটা প্রশ্ন।’

গত বছরের মাঝামাঝি থেকেই দেশের বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে এক ধরনের টানাপড়েন চলছিল। এই টানাপড়েনের অনেকগুলো ইস্যুর মধ্যে অন্যতম সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী ও নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরি-সংক্রান্ত শৃঙ্খলা ও আচরণ বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ নিয়ে। নির্বাহী বিভাগ এ দুটি বিষয় নিয়ে উদ্বেগে ছিল। তবে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে উচ্চ আদালতে করা মামলায় আপিল বিভাগের রায় সরকারি দলের বিপক্ষে যাবে-এমনটা ভাবনায় ছিল না নীতিনির্ধারকদের। এমনকি প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ আরো বেশি আশাহত করেছে তাদের। এমন পরিস্থিতিতে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল স্বাভাবিকভাবেই বিব্রত অবস্থায় পড়েছে।

এই সংকট কাটিয়ে উঠতে সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতিসহ প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণীরা বৈঠক করেন। এর আগে পর্যন্ত সরকারি দলের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মী ও প্রধান বিচারপতির মধ্যে রায় ইস্যুতে বক্তব্য পাল্টা বক্তব্যকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা চরম পর্যায়ে পৌঁছে। পরে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা গওহর রিজভীর সঙ্গে বৈঠকের পর বরফ গলতে শুরু করে। যার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন না করলে আমি প্রধান বিচারপতি হতে পারতাম না; ষোড়শ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর এটাই তার প্রথম ইতিবাচক মন্তব্য।

তবে গত বুধবার সংসদে ষোড়শ সংশোধনী রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে প্রধান বিচারপতির কঠোর সমালোচনার পর নতুন করে অমীমাংসিত বিষয়টি নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয় কি না এ নিয়ে কানাঘুষা শুরু হয়েছে। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে দেওয়া রায় এখতিয়ারবহির্ভূত এ কথা স্বীকার করেছেন আইনজ্ঞরা। তারা বলেছেন, রায়টি সংবিধানের প্রচলিত, আইনগত ও প্রথা মোতাবেক সঠিক নয়। এতে সংবিধান ও প্রথাগত ব্যত্যয় হয়েছে।

এদিকে, উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত রেখে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে গত ৩ জুলাই রায় দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। পরে ১ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন। সেখানে প্রধান বিচারপতি তার পর্যবেক্ষণে গণতন্ত্র, রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, সুশাসন, দুর্নীতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। এ নিয়ে প্রচ--ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ। নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয় পর্যবেক্ষণগুলো। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজনৈতিক ও আইনাঙ্গন। তবে, আলোচনার বাইরে থাকা সংসদে গত বুধবার রায়ের বিরুদ্ধে আইন পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে প্রস্তাব গ্রহণের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পেয়েছে।

অবশ্য আইনজ্ঞরা বলছেন, সংকট সমাধানের শেষ পথ রিভিউ। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ বা আপিল বিভাগের রায়ের পর তা সংশ্লিষ্ট বিচারক নিজে থেকে সংশোধন করতে পারেন না। কেবল রায়ের পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রায় সংশোধন অথবা কোনো পর্যবেক্ষণ প্রত্যাহার করা যায়। একই সঙ্গে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে করতে হবে।

সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বুধবার সংসদে রায়ের সমালোচনা করে বলেন, প্রধান বিচারপতি নিজেকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন; সংসদ, গণতন্ত্র সবকিছুকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের অধিকার হলো, ব্যত্যয় দেখলে ব্যাখ্যা দিতে পারেন। সংবিধান সংশোধন বা আইন প্রণয়নের এখতিয়ার তাদের নেই। তিনি বলেন, এ রায় কারো কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। একমাত্র বিএনপি খুব উৎফুল্ল হয়ে মিষ্টি বিতরণ করেছে। রায় হয়তো তারা পড়েনি। কারণ, রায়ে সামরিক শাসন অবৈধ হওয়ার বিষয় এসেছে।

রায় সমালোচনায় সংসদে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রধান বিচারপতি তার রায়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তিনি আমিত্বের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলেই আমিত্ব এসে যায়। কাউকে পছন্দ না হলে প্রধান বিচারপতি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন।

এক ব্যক্তি, প্রধান বিচারপতির কাছে জুডিশিয়ারি দায়বদ্ধ থাকবে। বিচারপতিরা চাকরি করতে পারবেন কি না, তা এক ব্যক্তির হাতে চলে যাচ্ছে। প্রধান বিচারপতি কারো প্রতি এতটুকু বৈরী হলে সেই বিচারপতির চাকরি থাকবে না। তিনি বলেন, যখনই গণতান্ত্রিক ধারা এগোতে থাকে, তখনই একটি বাধা এসে দাঁড়ায়। গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে হবে। গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায় যুক্তিনির্ভর নয়। আবেগতাড়িত ও বিদ্বেষপ্রসূত। তিনি বলেন, ২০১৫ সালে বিচারপতিদের অপসারণ-সংক্রান্ত একটি আইনের খসড়া করা হয়েছিল। এটা আদালতের কাছে পাঠিয়ে মন্তব্য চাওয়া হয়েছিল। প্রথমে তারা উত্তর দেয়নি। পরে জানায়, বিষয়টি বিচারাধীন, এ কারণে বক্তব্য দেওয়া যাবে না। তাতেই বোঝা যায়, এটা নিয়ে তাদের একটা পরিকল্পনা ছিল। আইনমন্ত্রী বলেন, আমরা আইনের দ্বারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত। সংবিধান সর্বোচ্চ আইন। সংবিধান ক্ষমতা দিলে কেউ তা কেড়ে নিতে পারে না। যে যুক্তিতে বাতিল করেছেন, সেসব গ্রহণযোগ্য নয়। প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করে আইনমন্ত্রী বলেন, কাউকে হেয়প্রতিপন্ন করে কথা বলা দায়িত্বশীল হতে পারে না। দায়িত্বজ্ঞান ও আইনি ভাষায় কথা বলার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। প্রধান বিচারপতির দুটিরই অভাব দেখা গেছে। তিনি বলেন, ১৯৭২ থেকে কোনো বিচারপতি এত কথা বলেননি। প্রধান সামরিক শাসকও এত কথা বলেননি।

রায়ের পর্যবেক্ষণ বাতিলের দাবি জানিয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, সর্বোচ্চ আদালত তার এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে রায় দিয়েছেন। এ রায় বারবার দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।

সংসদে প্রস্তাব তুলে ধরার পর প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে মইন উদ্দীন খান বাদল বলেন, তাদের কাছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য অস্ত্রধারী উত্তরপাড়াই উত্তম। প্রধান বিচারপতি প্রমাণ করতে পারবেন না, এই সংসদ বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করেছে। এ জন্যই তিনি আইনি পয়েন্ট থেকে সরে অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেছেন, যা বলার অধিকার তার নেই। বিচারপতিদের উদ্দেশে বাদল বলেন, রায়ের মধ্য দিয়ে আপনারা আপনাদের চেহারা উন্মোচন করেছেন। সে চেহারা জনগণকে প্রচণ্ড দুঃখ দেবে।

আর সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ বলেন, সংবিধানে তিন বিভাগের ক্ষমতা ভাগ করা আছে। কেউ সীমা অতিক্রম করতে পারে না। সংবিধানে দেওয়া ক্ষমতা নিয়ে কাজ করতে হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, সংসদের কোনো আইন যদি সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তাহলেই সেটি বাতিল করা যায়। কিন্তু কোনো আইন সংসদ অপরিপক্ব, রাজনৈতিক সংস্কৃতি খারাপ সেই কারণে অসাংবিধানিক হতে পারে না। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের তিনটি অরগান রয়েছে সংসদ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ যার যার কাজে স্বাধীন থাকবে। পাশাপাশি একে-অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু তাদের কাজে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকতে হবে, না হলে যেকোনো বিভাগ যেকোনো সময় স্বৈরচারী হয়ে উঠতে পারে। সম্প্রতি আপিল বিভাগের দেওয়া ষোড়শ সংশোধনী-সংক্রান্ত রায়ে তার প্রতিফলন ঘটেনি। সংশ্লিষ্ট রায়ে নির্বাহী বিভাগ ও সংসদের জবাবদিহিতা রয়েছে। কিন্তু এ রায়ে উচ্চ আদালতে কোনো জবাবদিহিতা নেই। আইনের এই অধ্যাপক আরো বলেন, রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে সংসদে সমালোচনা হয়েছে এতে কোনো আপত্তি থাকার কথা নেই। কিন্তু সংসদে বিচারপতিদের সম্পর্ক নেতিবাচক সমালোচনা সঠিক নয়। কারণ এতে পুরো বিচার বিভাগ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে অনান্থার সৃষ্টি হবে, যা আগামী প্রজন্মের জন্য সুখকর হবে না। তবে রায় প্রশ্নবিদ্ধ এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন সরকারের সামনে একটাই পথ রিভিউ করা। যদি এই প্রধান বিচারপতির প্রতি আস্থা না থাকে সে ক্ষেত্রে বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখে তার অবসরের পর নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের পর রিভিউ করতে পারে সরকার।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ষোড়শ সংশোধনী
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist