হামিম কামাল

  ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৪

আগুন আছে তোমাদের বুকে?

ছবি : সংগৃহীত

“বইমেলা আসছে না? দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।” এ হলো মেলার আগে আমাদের সাধারণ বাক্য। হয়তো নিছক একটা ইচ্ছেধারা কল্পনা। আর কিছু নয়। মেলা এলে, সত্যিই কি সব ঠিক হয়ে যায়? এগার মাসজুড়ে বুকে যে ব্যথা জমে, তা কি এক মাসে দূর হয়? নাকি ভুলে থাকা যায়। যে ব্যথা এগার মাস নয়, আট বছর এগার মাসজুড়ে বাজছে, বাজবে আজীবন, তা কি একুশে গ্রন্থমেলা দূর কর পারে? নাকি বারংবার মনে করিয়ে দেয়?

বিষণ্নতার কথা বলছি বলেই, বিষণ্নতা পুষছি এমন না। শক্তির কথাও বলি। পৃথিবী তো সব কিছুকেই টানছে নিজের দিকে। এই মহাশক্তির নাম অভিকর্ষ। সেই টানের বিরুদ্ধে নিয়ে, কোনো বস্তুকে যদি একটু ওপরে বা দূরে রেখে দিই, তাতে বিভব শক্তি জমা হয়। আমাদের বিবেক আছে। বিবেকের ভেতর কি এক ধরনের অভিকর্ষ আছে? সময়, বিবেক থেকে আমাদের যত দূরে নিয়ে যেতে থাকে, আমাদের ভেতর তত বিভব জমতে থাকে। আমরা বিবেকের দিকে ছুটে যাওয়ার তাগাদা তত তীব্রভাবে অনুভব করতে থাকি। সেই তাগাদার একটা দৃশ্যমান রূপ গ্রন্থ।

হ্যাঁ, এটাও শুনেছি বিবেকের প্রতিনিধিত্ব করবেই, এমন কথা গ্রন্থ দেয় না। সে কথাও ঠিক। সব গ্রন্থ এক নয়। যে কারণে, সব গ্রন্থ সবার নয়।

গ্রন্থেরও শুভ-অশুভ আছে। নিজ বিশ্বাসের বাইরের গ্রন্থকে অশুভ-অশুভ লাগে, তাই গ্রন্থের শুভাশুভ নিয়ে বিবাদ হয়ত চলবেই। আমি এখানে বিবেকের অনুবর্তী গ্রন্থকে শুভ গ্রন্থ মেনে কথা বলছি। একুশে গ্রন্থমেলা যখন বছর ঘুরে আসে, শুভ গ্রন্থগুলো বিরাট মাঠ জুড়ে যখন একত্রিত হয়, তখন একটা পবিত্র বিভা জাগে।

এ বিভার জন্ম কোথায়? আমার প্রিয় লেখকদের একজন করম্যাক ম্যাকার্থির দ্য রোড গ্রন্থে বিশেষ একটি মুহূর্তে এক আগুনের আছে। উপন্যাসের ছোট্ট ছেলেটি নতুন মানুষগুলোর কাছে জানতে চায়, Are you carrying the fire?

ওরা বলে, Am I what? কারণ ওরা বুঝতে পারেনি ছেলেটা কোন আগুনের কথা বলছে। ওরা বুঝতে পারছে বলে বোধহয় ছেলেটাও একটু নিষ্প্রভ হয়ে আসে। মনে ভয়, আবারও বলে, Carrying the fire.

এখানটায় চোখ ভিজে আসে। গলা ধরে আসে। যে আগুনের পরশমণি আমাদের সাহিত্য রবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রাণে ছোঁয়ানোর প্রার্থনা জানিয়েছেন, সেই আগুনের বিভা, তার শুভ আঁচ একুশে গ্রন্থমেলায় পাওয়া যায়।

তবু ব্যথা বাজে। শুরু অনুচ্ছেদের গিঁট না দেওয়া সুতার কাছে ফিরে যাচ্ছি। একদিন, এই মেলাফেরৎ একজন মানুষের রক্তাপ্লুত জীবনাবসান ঘটেছিল মেলার প্রাঙ্গণেই। অভিজিৎ রায়ের কথা ভুলি কি করে? একুশে গ্রন্থমেলা এলেই মনে পড়ে যায়। আলাপ করতে নয়, হত্যা করতে যারা এসেছিল, তারা এমন এক প্রাণ ছিনিয়ে নিতে এসেছিল সে প্রাণ তারা দান করেনি। আর নেওয়ার পর রাখার মতোন পাত্রও তাদের নেই। কারা সেই হত্যাকারী? যাদের বুকের সেই আগুন নিভে গিয়েছিল।

সেই আগুন নিভে গেলেই কেউ হত্যাকারী হয়।

প্রার্থনা সেই যে পরশমণি-আগুন তার আকর এই মেলা থেকে ফাগুন নিয়ে ফেরার কালে, আর কখনো, কাউকে যেন ‘অভিজিৎ রায়’ হতে না হয়।

প্রতিবছর মেলা রূপ বদলাচ্ছে। ফিবছর মেলার একটা সৌন্দর্য নিভে যায় তো আরেকটা জাগে। এ নিয়ে ভাবনা নেই। যে কথা বিস্ময় নিয়ে ভাবি, তা হলো, ফেব্রুয়ারি আমাদের জাগৃতিকাল এবং পৃথিবীতে আর ক’টি ভূখণ্ডের মানুষের জাগরণের কালটি প্রকৃতিরও বসন্তকাল? বোধহয় বেশি নয়। একুশের গ্রন্থমেলা এ ভূখণ্ডের সকল বাঙালির, আদিবাসীর জন্য বসন্তবিভা স্বরূপ। তাদের হৃদয়ের আগুনের নিধি। যে কারণে আগের মতোন আনন্দ নিয়ে না বলতে পারলেও, বন্ধুদের মুখে হয়ত এই কথাটা আগে মতোই থেকে যাবে। “বইমেলা আসছে না? দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

বইমেলা এসেছে। সব ঠিক হয়ে যাক।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৪
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close