শাহ্জাহান সাজু

  ৩১ অক্টোবর, ২০১৮

অনুমোদন পেল কমিউনিটি পুলিশ ব্যাংক

অপেক্ষায় আরো ৩টি

দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই আরো চারটি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দিতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে পুলিশের কমিউনিটি ব্যাংককে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিবেচনায় থাকা বাকি তিনটি ব্যাংকের অনুমোদনের বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম গত সোমবার রাতে সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান। কমিউনিটি ব্যাংক চালু করার প্রস্তাব করেছিল বাংলাদেশ পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্ট (বিপিডব্লিউটি)। এটি কার্যক্রম শুরু করলে বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা হবে ৫৯।

তিনি বলেন, সোমবার রাতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সভায় কমিউনিটি পুলিশ ব্যাংককে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে প্রস্তাবিত বাকি তিনটি ব্যাংক দ্য বেঙ্গল ব্যাংক, পিপলস ব্যাংক, দ্য সিটিজেন ব্যাংকের বিষয়ে এখনো অনুমোদন সংক্রান্ত চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

তিনি আরো বলেন, বাকি তিনটি ব্যাংকের মধ্যে বেঙ্গল ব্যাংকের আবেদনে যে পরিচালকদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল তাদের মধ্যে তিনজনের বিরুদ্ধে করসংক্রান্ত মামলা থাকায় অনুমোদন দেওয়া হয়নি। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের কোনো পরিচালক আদালতের রায়ে সাজাপ্রাপ্ত হলে তিনি আর ওই ব্যাংকের পরিচালক থাকতে পারবেন না। তাই যেহেতু আবেদন করা বেঙ্গল ব্যাংকের তিন উদ্যোক্তা পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে সেহেতু তাদের পরিচালক রাখলে কোনো অবস্থাতেই ব্যাংকটির অনুমোদন দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানান তিনি। আর পিপলস ব্যাংকের চেয়ারম্যানের যুক্তরাষ্ট্রে কী পরিমাণ নিট সম্পদ আছে সেটি জানতে চাওয়া হয়েছে। সিটিজেন ব্যাংকের কাগজপত্রে কিছু ত্রুটি আছে সেটি সংশোধন করে নতুন প্রস্তাব জমা দিতে বলা হয়েছে।

জানা যায়, পর্যায়ক্রমে এই চারটি ব্যাংকেরই লাইসেন্স দেওয়া হবে। বর্তমানে দেশে ৫৮টি তফসিলভুক্ত ব্যাংক রয়েছে। কমিউনিটি পুলিশ ব্যাংক চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ায় এখন তফসিলি ব্যাংকের সংখ্যা দাঁড়াল ৫৯টিতে। আর বাকি তিনটি ব্যাংক অনুমোদন পেলে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৬২টিতে।

আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে ৯টি ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এমন সময়ে নতুন চার ব্যাংকের অনুমোদন দিতে যাচ্ছে; যখন পুরো ব্যাংক খাত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। শুধু তাই নয় এর আগে লাইসেন্স পাওয়া ৯টি ব্যাংকের মধ্যে ফারমার্স ব্যাংক দেউলিয়ার পথ থেকে এখনো স্বাভাবিক ধারায় ফেরেনি। অন্য আটটির মধ্যে বেশিরভাগই এখনো খুব বেশি ভালো অবস্থায় নেই।

জানা যায়, গত বছর অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে চাপ আসা সত্ত্বেও নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার প্রস্তাবটি স্থগিত রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংকাররা নতুন ব্যাংকের বিষয়ে বরাবরই বিরোধিতা করে বলছেন, বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি হয়ে গেছে। বর্তমান অবস্থায় দেশে আর ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। তবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতসহ সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে ক্রমাগত আসতে থাকা চাপে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিরোধ টেকেনি। সর্বশেষ অর্থমন্ত্রী গত ২৫ সেপ্টেম্বর এক চিঠিতে এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দেন কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। এ সংক্রান্ত এক চিঠিতে তিনি বলেন, সম্ভবত বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি প্রস্তাবিত একটি ব্যাংককে লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি আপনাকে প্রস্তাবিত সব ব্যাংককে একে একে লাইসেন্স দেওয়ার অনুরোধ করছি। সম্প্রতি এক বৈঠকে প্রস্তাবিত ব্যাংকগুলো লাইসেন্স প্রদানে সম্মত হয়েছেন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিরা, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে, গত ২৪ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, দেশের ব্যাংক খাত খুব বেশি বড় হয়ে গেছে। আর্থিক খাতের চাহিদার তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি বলে ব্যাংকাররাই মনে করছেন। তাই এ খাত সংকোচনের দরকার হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নতুন কোনো ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়ার যোক্তিক কোনো কারণ নেই। তাছাড়া নতুন কোনো ব্যাংক নতুন করে কোনো সেবা নিয়ে আসবে বলেও মনে হয় না।

জানা যায়, এর আগে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরই নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দিতে উদ্যোগী হয়। শুরুর দিকে আপত্তি থাকলেও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক পিছু হটে। পরে ফারমার্স ব্যাংকসহ নতুন ৯টি ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার ব্যবস্থা করে সরকার। এরপর অবশ্য বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) ‘সীমান্ত ব্যাংক’ নামের আরেকটি ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়। সর্বশেষ গত জুলাই মাসে বিশেষায়িত প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংককে বাণিজ্যিক লেনদেনের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতার কারণেই সম্প্রতি নতুন ব্যাংক দেওয়ার প্রশ্নে বাংলাদেশ ব্যাংক শুরুতে আপত্তি জানিয়েছিল। তবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে আগেও তারা পিছু হটেছে, যার পুনরাবৃত্তি ঘটছে এবারও।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ও ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার পুরোপুরি এখতিয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে। কিন্তু নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স পাওয়া সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল।

এদিকে কমিউনিটি ব্যাংক অব বাংলাদেশের মালিক হচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যরা। পুলিশ সদস্যদের কল্যাণ ফান্ডের টাকায় এই ব্যাংকটি পরিচালিত হবে। বেঙ্গল ব্যাংকের (বাংলা ব্যাংক) মালিক হচ্ছেন বেঙ্গল গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান মো. জসিম উদ্দিন। তিনি দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সহ-সভাপতি ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মোরশেদ আলমের ছোট ভাই। দ্য সিটিজেন ব্যাংকের মালিক হলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মা জাহানারা হক। অন্যদিকে, পিপলস ব্যাংকের প্রধান উদ্যোক্তা চট্টগ্রামের বাসিন্দা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এম এ কাশেম, যিনি যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি।

জানা যায়, বেশ কিছু শর্তে নতুন ব্যাংকগুলোকে লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে তিন বছরের মধ্যে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) ইস্যু, মোট ঋণ ও অগ্রিমের অন্তত পাঁচ শতাংশ কৃষি ও পল্লী ঋণ খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। লাইসেন্স পাওয়ার পর ৪০০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন জোগাড় করে কার্যক্রম শুরু করতে পারবে নতুন ব্যাংকগুলো।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close