নাহিদ হাসান রবিন

  ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৯

লাল কৌটা ও আলতা বিবি

পৃথিবীর কিছু মানুষের জন্ম হয় শুধু দুঃখের সাগরে সাঁতার কাটার জন্য। আলতা বিবি তেমনই একজন। নাই খাইয়ের সংসারে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বিয়ে হয় আরেক নাই খাইয়ের সংসারের ছেলে আক্কেল আলীর সঙ্গে। নাম আক্কেল হলেও লোকটি আসলে পুরোটাই বে-আক্কেল। গ্রামের লোকজনের সঙ্গে প্রতিদিনই ঝগড়াঝাটিতে লেগে থাকত। বাড়ি ফিরে আলতা বিবির ওপর তার জের নামাত।

যা হোক, বেচারা মারা গেছে বছর দশেক হবে। মাথার ওপর থেকে ছাতা সরে গেলেও হুমকি-ধমকি আর শারীরিক নির্যাতনের হাত থেকে বেঁচেছে আলতা বিবি। স্বামী মারা যাওয়ার সময় একটা টিনের ছাপরা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। দুটো বাচ্চা নিয়ে দুঃখের সাগরে ভাসতে থাকে আলতা বিবি। চেহারা সুরত খুব ভালো না হলেও স্বামী না থাকায় গ্রামের অনেক লম্পট লোকের লোভাতুর চোখ এড়িয়ে চলতে হয়েছে তাকে। সারা দিন মাটি কাটার কাজ করে সন্ধ্যায় বসে বাজারের এক কোণে পিঠা বিক্রি করত। দীর্ঘদিন এসব করে কিছু টাকা জোগাড় করে মেয়ে দুটোকে বিয়ে দিয়েছে। এখন সংসার নামক জায়গাটিতে আলতা বিবি একা। বয়সও হয়ে এসেছে। মাটি কাটার কাজ আর করতে পারে না। মাঝে মাঝে এ বাড়ি-ও বাড়ি ঠিকা কাজ করে। কখনো দুমুটো খেয়ে, কখনো না খেয়ে আঁচলের কোনায় এক পোয়া আধা সের চাল নিয়ে আসে। দু-এক মাস কাজ করে যে আয় করে একবার মেয়েজামাই আর নাতি-নাতনি বেড়াতে এলে তা এক দিনেই শেষ হয়ে যায়। কিছুদিন হয় গ্রামের মেম্বার সাহেব একটা কাজ দিয়েছে। ভোরবেলা আজান হওয়ার পরই হাটখোলা ঝাড়– দিতে হয়। এখান থেকে সপ্তাহে ২০০ টাকা পায়। আর হাটবারের পরদিন সকালে মাঝে মাঝেই হাঁটুরেদের হারিয়ে যাওয়া দু-চার টাকা কুড়িয়ে পায়। মাঝে মাঝে নষ্ট হওয়া কিছু সদাইপাতিও মেলে। এসব দিয়ে বেঁচে থাকার মতো চলে তার জীবন।

সারা দেশে এখন রাজনৈতিক অস্থিরতা। সরকারকে হটানোর জন্য ব্যস্ত বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা। শহরের পাশাপাশি গ্রামের হাটবাজারেও এখন রাজনীতির ঝড় উঠেছে। চন্দন নগর হাটের মধ্যে মমতাজ আলীর চায়ের দোকানে অনেক রাত পর্যন্ত লোকজন আড্ডা দেয়। একটা গ্রামের লোকজন নিয়ে ছোট্ট বাজার। এখানে বাইরের লোকজন তেমন আসে না। ইদানীং দেশের রাজনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় নানা জায়গার লোকজন বাজারে এসে আড্ডা দেয়। সারা দিন হইচই শোনা যায়। আগে সন্ধ্যার পরই মমতাজের চায়ের দোকান বন্ধ হয়ে যেত। এখন রাত ১১টা-১২টা পর্যন্ত ধুমচে আড্ডা হয় সেখানে। কয়েক দিন আগে দুই দলের লোকজনের মধ্যে মারামারিও হয়েছে। অবশ্য দেশের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে আলতা বিবির কোনো মাথাব্যথা নেই। থাকার কথাও না। একে তো মেয়ে মানুষ তার ওপর আবার গরিব, ওদের এসব চিন্তা মাথায় থাকার কথাও না। প্রতিদিনের মতো ফজরের আজানের পর বাজার ঝাড়– দিতে বের হয় আলতা বিবি। হাটের এক কোনায় কুড়িয়ে পায় ছোট্ট একটা কাপড়ের ব্যাগ। ওপরের ফিতা খুলে ভেতর থেকে প্যাকেট বের করে চোখ জোড়া আসমানে ওঠে। এক বান্ডিল টাকা। এত টাকা সে এর আগে কখনো দেখেনি। কত টাকা হবে অনুমান করতে পারে না। পুরো বাজার ফাঁকা। লোকজন এখনো ঘরের বাইরে বের হয়নি। আলতা বিবি চারদিক একবার দেখে নিয়ে একটা দোকানের সামনে বাঁশের মাচায় বসে টাকাগুলো দেখতে থাকে, মনে মনে কল্পনা করতে থাকে- এখন আর কোনো অভাব থাকবে না। মেয়েজামাই, নাতি-নাতনিদের ভালো মতো খাওয়াইতে পারবে। কেনাকাটা করে দিতে পারবে। এসব ভাবতে ভাবতে ব্যাগের ভেতর হাত দিয়ে দেখে তাতে আর কী আছে। না দুইখান বই আর জর্দার কৌটার মতো ৫টা লাল কৌটা ছাড়া আর কিছু নেই। কৌটাগুলো ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে তাড়াতাড়ি করে ঝাড়–র কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরে।

আজ আর কোনো দিকে মন বসছে না। এত টাকা কী করবে, তাই ভাবছে। আর মাঝে মাঝেই ব্যাগ থেকে টাকাগুলো বের করে দেখছে। লাল কৌটাগুলোর মধ্যে কী আছে বুঝতে পারছে না, খোলার মতো কোনো জায়গাও খুঁজে পাচ্ছে না। পুরোনো চটের বিছানায় বসে কৌটাগুলো হাঁটুর নিচে রেখে টাকাগুলো নাড়তে থাকে। হঠাৎ বিকট শব্দ। চারদিক থেকে লোকজন দৌড়ে আসে। একটি স্বাধীন দেশে চটের ওপর রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পড়ে আছে আলতা বিবির লাশ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close