আফরোজা পারভীন

  ২৯ নভেম্বর, ২০১৯

জীবনবাদী মানিক

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক। পিতার চাকরি সূত্রে সাঁওতাল পরগনার দুমকায় তার পরিবার চলে আসে। এখানেই তার জন্ম। প্রকৃত নাম প্রবোধ কুমার, মানিক ডাকনাম। ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের মালবদিয়া গ্রামে পৈতৃক নিবাস ছিল। পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের গ্র্যাজুয়েট ছিলেন। সেটেলমেন্ট বিভাগে চাকরি করতেন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে অবসর নেন।

বারবার স্কুল বদলাতে হয়েছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। দুমকা, আড়া, সাসারাম, কলকাতা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বারাসাত, টাঙ্গাইল ও মেদিনীপুরের স্কুলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাগ্রহণ করেন। মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকে ১৯২৬ সালে অ্যান্ট্রান্স পাস করেন। বাঁকুড়া ওয়েযসলিয়ন মিশন কলেজ থেকে ১৯২৮ সালে আইএসসি পাস করে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে বিএসসিতে ভর্তি হন, কিন্তু পাঠ অসমাপ্ত রেখেই পেশাগত জীবনে প্রবেশ করেন। ‘উদয়াচল প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিশিং হাউস’ ১৯৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪০ সাল পর্যন্ত সহোদরের সঙ্গে ওই হাউস পরিচালনা করেন। একই সঙ্গে বঙ্গশ্রী (১৯৩৭-৩৯) পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। কিছুদিন ভারত সরকারের ন্যাশনাল ওয়ার ফ্রন্টের প্রভিন্সিয়াল অরগানাইজার এবং বেঙ্গল দফতরে প্রচার সহকারী পদেও কর্মরত ছিলেন।

ত্রিশোত্তর বাংলা কথাসাহিত্যের একজন শক্তিমান লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। নদীনালা, খালবিল, তেলে-জল সঙ্গে নিয়েই বড় হয়ে ওঠেন। তাই সাধারণ মানুষের কথা, জীবন, পারিপার্শ্বিক চিত্রগুলো নিপুণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হন। অভিজ্ঞতার ভারে নুইয়ে পড়া মানিক পাঠককে তার অভিজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ রাখতেই লেখা শুরু করেন। জীবনের প্রথম পর্বে মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড, ইয়ুং, অ্যাডলার প্রমুখ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। পরবর্তীতে মার্কসবাদে দীক্ষা নেন। ১৯৪৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য হন। আমৃত্যু এই দলের কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন। তাই সামাজিক শ্রেণি-বৈষম্য, শোষণ, নিপীড়ন, অসংগতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল তার লেখনী।

প্রথম গল্প ‘অতসী মামী’ প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সালে ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায়। তখন তিনি স্নাতক শ্রেণির ছাত্র। গল্পটি পাঠক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করে। মেধা, নিরলস পরিশ্রম ও আন্তরিকতার ফলে অল্প সময়ে প্রতিষ্ঠিত লেখকের মর্যাদা লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র ধারার বিরোধিতা করে ‘কল্লোল গোষ্ঠী’-এর আবির্ভাব ঘটে বিশ শতকের তিরিশের দশকে। এই গোষ্ঠীর লেখক হিসেবে মানিকের স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে ওঠে।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন-অভিজ্ঞতা ছিল ব্যাপক ও গভীর। ফলে তিনি জীবনকে দেখতেন সমগ্রতায়, খন্ড খন্ড করে নয়, অখন্ডতায়। এটি তার প্রধান গুণ এবং লেখক মাত্রেরই শ্রেষ্ঠ গুণ। তিনি যেমন ফ্রয়েডীয় মতবাদে প্রভাবিত হয়েছিলেন; ঠিক তেমনি জীবনের, মনুষ্য জীবনের মুক্তি দেখেছিলেন মার্কসবাদে। মার্কসবাদই তাকে দীক্ষা দেয়। এই মতবাদেই তিনি জীবন ও জগৎ সম্পর্কে যে বিশ্বাস পোষণ করেন, তাই তার সাহিত্য জীবনের পাথেয়।

ব্যক্তিগতভাবে মানিক ছিলেন মধ্যবিত্ত মানসিকতার উত্তরাধিকারী। তার প্রথম গল্পগুচ্ছ ‘অতসী মামী ও অন্যান্য’ সংকলনে সবকটি গল্প এবং প্রথম উপন্যাস ‘দিবারাত্রির কাব্য’ মধ্যবিত্ত জীবনভিত্তিক কাহিনি নিয়ে গড়া। তিনি যখন কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের মুখে এসেছিলেন; তখন থেকেই বাঙালির মধ্যবিত্ত জীবনে সার্বিক অবক্ষয়ের চেতনা চারপাশ থেকে ঘিরে চেপে বসতে চাইছিল। বিশ্বজোড়া মধ্যবিত্ত বৈমানসিকতা বোধের তাড়নায় বাংলা সাহিত্য তখন পীড়িত। পাঠকের অভিজ্ঞতাতেও এ নিয়ে তারতম্য ছিল না। তবু তার অন্তরের প্রত্যাশা ছিল অন্ধকারের অতল থেকে উঠে উত্তরণের পথ খোঁজার। সেজন্যই তিনি চিরস্মরণীয় ও বরণীয়।

মানুষের অন্তর্জীবন ও মনোজগতের রহস্য উন্মোচনেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। তার রচনায় নিপুণভাবে বিশে¬ষিত হয়েছে মানুষের অবচেতন মনের নিগূঢ় রহস্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পঞ্চাশের মন্বন্তর পরবর্তী রচনায় তার সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা নাগরিক জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করে, তার নিখুঁত চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তার এ পর্যায়ের রচনায়। এ বিষয়ে তিনি একজন দক্ষ রূপকার। একাধারে শহর ও গ্রামজীবনকে রূপায়িত করেছিলেন তিনি। দ্বন্দ্ব সংশয় সংগ্রাম পটভূমিও তার উপন্যাস ও গল্পে গুরুত্ব পেয়েছে।

তিনি বিশাল বিস্তীর্ণ নদ-নদীর পটভূমিকায় সাধারণ মানুষের বস্তুনিষ্ঠ জীবনচিত্র অঙ্কন করেছেন। তেমনি মানুষের কর্মে-পিপাসায় জীবনচিত্র তুলে ধরতে গিয়ে আদিমতার অন্ধকারে ফিরে গেছেন বারবার। অদ্ভুত নিরাসক্তভাবে তিনি মানুষের জীবন ও সমস্যাকে দেখেছেন, সমাধানের চেষ্টাও করেছেন বুদ্ধি ও লেখনীতে। নর-নারীর জৈবসত্তা বিকাশের নানাদিক তাকে আকৃষ্ট করেছিল। তার লেখায় জৈবসত্তা ও দৈহিক বর্ণনায় ছিলেন অকপট।

অর্ধশতাধিক উপন্যাস ও ২২৪টি গল্প তিনি রচনা করেছেন। তার উলে¬খযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ : উপন্যাস জননী (১৯৩৫), দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫), পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৩৬), পুতুল নাচের ইতিকথা (১৯৩৬), শহরতলী (১৯৪০-৪১), চিহ্ন (১৯৪৭), চতুষ্কোণ (১৯৪৮), সার্বজনীন (১৯৫২), আরোগ্য (১৯৫৩) প্রভৃতি। ছোটগল্প : অতসী মামী ও অন্যান্য গল্প (১৯৩৫), প্রাগৈতিহাসিক (১৯৩৭), সরীসৃপ (১৯৩৯), সমুদ্রের স্বাদ (১৯৪৩), হলুদ পোড়া (১৯৪৫), আজ কাল পরশুর গল্প (১৯৪৬), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৫০), ফেরিওয়ালা (১৯৫৩) ইত্যাদি। পদ্মা নদীর মাঝি ও পুতুল নাচের ইতিকথা উপন্যাস দুটি তার বিখ্যাত রচনা। এ দুটির মাধ্যমেই সর্বাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। পদ্মা নদীর মাঝি চলচ্চিত্রায়ণ হয়েছে। তার লেখা পাঠকের চেতনাকে নাড়া দিতে পেরেছে বলেই পাঠকের কাছে আদরণীয়।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অসচ্ছলতার চাপ ব্যক্তিগতভাবে ভোগ করছেন প্রায় আগাগোড়া। নিজে চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেছেন। কিন্তু থেমে যাননি, আপস করেননি। সাহিত্যচর্চাকেই পেশা হিসেবে ধরে রেখেছেন। তার দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই, প্রবল নিষ্ঠা আর একাগ্রতা দেখে একসময় পশ্চিমবঙ্গ সরকার তার জন্য সাহিত্যিক বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। নিজে অভিজ্ঞতা ঋদ্ধ ছিলেন বলেই দারিদ্র্যের স্বরূপ, দারিদ্র্যের কারণে মানুষের যন্ত্রণা হতাশা মনোবিকলন তিনি বুঝতে পারতেন। বুঝতেন দারিদ্র্যের সঙ্গে যৌনাকাক্সক্ষা আর উদরপূর্তির সমস্যা। এরই একটি বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কবিতা লিখেছেন, নাটক লিখেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন; কিন্তু আসলে তিনি কথাশিল্পী, ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার; যা তার প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছে।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাকে ঔপন্যাসিক হিসেবেই চিহ্নিত করতে চেয়েছেন; অন্যকিছু তিনি নন, তিনি ঔপন্যাসিক। কিন্তু আমরা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিহ্নিত করব একই সঙ্গে গল্পকার ও ঔপন্যাসিক হিসেবে। কারণ তিনি কেবল ঔপন্যাসিক হিসেবে সফল নন, বরঞ্চ গল্পকার হিসেবে সফলতা অর্জন করেছেন।

এ প্রসঙ্গে সুকুমার সেন মনে করেন, ‘ছোটগল্পগুলোতেই শিল্পী মানিক বাবুর শ্রেষ্ঠ পরিচয় নিহিত।’

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তিন দশক ধরে লিখেছিলেন প্রায় ৪০টির মতো উপন্যাস এবং তিনশতর মতো গল্প। তিনি তার সংক্ষিপ্ত ৪৮ বছরের জীবনকে সম্পূর্ণ উৎসর্গ করেছিলেন সাহিত্যে।

অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত মানিককে বলেছেন, ‘কলে¬ালের কুলবধন।’

‘কেন লিখি’ নামের পত্রিকায় লেখা সম্পর্কে মানিক বলেন, ‘লেখা ছাড়া অন্য কোনো উপায়েই যেসব কথা জানানো যায় না, সেই কথাগুলো জানানোর জন্যই আমি লিখি।’ ‘ছোটগল্প রচনায় রোমাঞ্চ আছে। এতে গভীর মনোসংযোগ করতে হয়। এত দ্রুত তালের সঙ্গে সংগতি রক্ষা করে চলতে হয় বলেই মন কখনো বিশ্রাম পায় না। ছোটগল্প লেখার সময়ে প্রতিমুহূর্তে রোমাঞ্চ বোধকরি।’

‘কেন লিখি’-এর তিন বছর পরে ১৯৪৭ সালে, শারদীয় ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘প্রতিভা’ নামে আরেকটি প্রবন্ধ লেখেন। ওই প্রবন্ধে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন প্রতিভা কোনো ‘ঈশ্বরপ্রদত্ত রহস্যময় জিনিস’ নয়। বোঝালেন, ‘প্রতিভা আসলে এক। বৈজ্ঞানিক আর কবির প্রতিভায় মৌলিক পার্থক্য কিছু নেই- পার্থক্য শুধু বিকাশ আর প্রকাশে।’ এখানে ‘কবি’ বলতে লেখক শিল্পী মাত্রকেই বুঝিয়েছেন। আর প্রতিভা জিনিসটা কী?- না, ‘দক্ষতা অর্জনের বিশেষ ক্ষমতা।’ এ ছাড়া আর কিছুই নয়।

দৈহিকভাবে অসুস্থ হলেও মানসিকভাবে যথেষ্ট বলিষ্ঠ ছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই বলিষ্ঠতা রক্তের উষ্ণস্রোত উত্তাপ টের পাওয়া যায় তার গল্প-উপন্যাসের চরিত্রের বর্ণনায়, পেশায়, কাজেকর্মে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close