নূর কামরুন নাহার

  ২২ নভেম্বর, ২০১৯

সুফিয়া কামালের প্রেমভাবনা

সুফিয়া কামাল স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, “এমনি কোনো বর্ষণমুখর দিনে মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘হেনা’ পড়ছিলাম বানান করে। প্রেম, বিরহ, মিলন এসবের মানে কি তখন বুঝি? তবু যে কী ভালো, কী ব্যথা লেগেছিল তা প্রকাশের ভাষা কি আজ আর আছে? গদ্য লেখার সেই নেশা। এরপর প্রবাসী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পড়তে পড়তে অদ্ভুত এক মোহগ্রন্তভাব এসে মনকে যে কোন্ অজানা রাজ্যে নিয়ে যেত। এরপর দেখতাম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, বেগম সারা তাইফুর লিখছেন। কবিতা লিখছেন বেগম মোতাহেরা বানু। মনে হলো, ওরা লিখছেন আমিও কি লিখতে পারি না? শুরু হলো লেখা লেখা খেলা। কী গোপনে, কত কুণ্ঠায়, ভীষণ লজ্জার সেই হিজিবিজি লেখা ছড়া, গল্প। কিন্তু কোনোটাই কি মনের মতো হয়! কেউ জানবে, কেউ দেখে ফেলবে বলে ভয়ে ভাবনায় সে লেখা কত লুকিয়ে রেখে আবার দেখে দেখে নিজেই শরমে সংকুচিত হয়ে উঠি।”

প্রেম বিরহ অথবা ভালোবাসার মানে না বুঝে যিনি অনুভব করেন ব্যথা, আর সে ব্যথা প্রকাশের ভাষা যিনি রাখেন না, সেই কবি যে প্রেমের অদ্ভুত দ্যোতনাতেই কবিতা লিখবেন এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কবি সুফিয়া কামালের কবিতায় আমরা তাই প্রেমের অসম্ভব সুন্দর আনন্দ-বেদনার দোলা, দেখি প্রেম বিরহ আর ভালোবাসার নান্দনিক প্রকাশ। মূলত প্রেমভাবনা তার কবিতার অন্যতম অনুষঙ্গ।

প্রেম এক দুর্মর, আশ্চর্য সুন্দর অনুভব। প্রেম রহস্যময়ও বটে। এই রহস্য ঘোর কবির আজীবনের প্রার্থনা আর সৃষ্টিশীলতার প্রেরণা। প্রেমানুভূতির অনিন্দ্য সুন্দর প্রকাশ দেখি সুফিয়া কামালের কবিতায়Ñ

‘মৃত্তিকার ভা- ভরি’ উচ্ছ্বসিত তোমার সে প্রেম/তারে আমি ভরিয়া নিলেম/আমার নয়ন ভরে, আমার হৃদয় ভরে/আর ভরে আমার দু’কর!/কী দুঃসহ সে আনন্দ, সেই প্রেম কী যে তীব্রতর!’

প্রেম প্রতীক্ষার, প্রেম আরোধনার। যুগ যুগ প্রতীক্ষার পর দেখা মিলে প্রেমের ইস্পিত সেই মানুষের। এই প্রেমর জন্য শতাব্দীর পর শতাব্দী আরোধনা করেছেন কবি সাহিত্যিক শিল্পী। তবু যেন ধরা দেয়নি প্রেম, সেই সে জন। সুফিয়া কামালের কবিতায়ও আমরা দেখি প্রেমের জন্য, সেই কাক্সিক্ষত মানুষের জন্য অপেক্ষা আর আকুলতাÑ

‘তোমারে খুঁজিয়া ফিরি, জন্ম হতে যুগ যুগ ধরি/অধীর উৎসুক চিত্তে, কর্মক্লান্ত নিদ্রাহীন দিবস শর্বরী/করিতেছি তোমার ধেয়ান/হে বল্লভ! অপরূপদান।’

এই যে যুগের যুগের সন্ধান এবং এই যে ধ্যান এবং তারপর যে প্রাপ্তি সেই প্রাপ্তিতেও মন মানে না, প্রেমিকের দুরুদুরু বক্ষ বারবার প্রশ্ন জাগে, সত্যি সে ভালোবাসেছে তো? সত্যি কি তার প্রিয় মানুষ তাকেই পছন্দ করে? নাকি এ মোহ, ক্ষণিকের ভালো লাগা? এও প্রেমের চিরন্তন বোধ, শঙ্কা আর দোদুল্যমানতা। এই দোদুল্যমানতাই প্রেমকে করে আরো নিবিড়, আরো তীব্র। প্রেমিক হৃদয়ের এক গভীর গোপন অভিলাষ ভালোবাসাকে গভীরভাবে অনুভব করার গভীর তৃষ্ণা, প্রিয়কে সম্পূর্ণরূপে পাওয়ার আকুলতা। এই আকুলতা, এই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাও আমরা দেখি সুফিয়া কামালের কবিতায়Ñ

‘বৃন্তচ্যুত কবি পুষ্পে পরেছিলে বুকে,/হে খেয়ালী! খেয়ালে কৌতুকে!/ভালোবেসে নহে, ভালো লেগেছিল তার বাস/ক্ষণিকের লাগি। বর্ণ, রূপ, বিকাশের বেদনা বিলাস।’

সুফিয়া কামালের প্রেমভাবনার আরো একটি প্রধান অনুষঙ্গ হলো বিরহ। এই বিরহ প্রতীক্ষারই আরেক রূপ। এই বিরহেও সেই মিলনের আকুলতা। মূলত প্রেম আর মিলন প্রত্যাশী। এই মিলনের প্রতীক্ষায় জাগিয়ে রাখে মানুষকে আশায় আর ভালোবাসায়Ñ

‘কত দিন, কত মাস, কত বর্ষ হয়ে গেল গত/তোমার আসার আগে জাগিয়া সতত/সতর্ক শঙ্কায়/ক্লান্ত আঁখি তবুও না পথ হতে ফিরিবারে চায়।’

সুফিয়া কামালের এই বিরহের রূপ আমরা পরিপূর্ণভাবে পাই তার সাঁঝের মায়ায়। এখানেই কবি বিরহী, প্রেম প্রতীক্ষারত। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তার জীবনের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘কেয়ার কাঁটা’ ও ১৯৩৮ সালে কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁঝের মায়া’। কবি বেনজীর আহমদ ‘কেয়ার কাঁটা’ ও ‘সাঁঝের মায়া’ প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং লেখক-সম্মানীর ব্যবস্থাও করেছিলেন। কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ সুফিয়া কামাল তার ‘মন ও জীবন’ কাব্যগ্রন্থটি বেনজীরকে উৎসর্গ করেন। এই বই দুটি বিশেষ করে সাঁঝের মায়ার মাধ্যমে সাহিত্য সমাজে নতুনভাবে আবির্ভাব ঘটে সুফিয়ার। ‘সাঁঝের মায়া’র মুখবন্ধ লিখেন কাজী নজরুল ইসলাম। বইটি প্রকাশ হওয়ার পর চারপাশ থেকে কবি প্রশংসা পেতে থাকেন। প্রশংসাকারীদের মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও।

কবি বা শিল্পীদের ব্যক্তিজীবনকে আমরা দেখতে পাই তার সৃষ্টিতে। কারণ শিল্পী তার অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই গড়ে তুলেন সৃষ্টির ভুবন। ‘সাঁঝের মায়া’তেও আমরা দেখতে পাই কবির ব্যক্তিগত বেদনা ও কষ্টের নান্দনিক প্রকাশ। ব্যক্তিজীবনে প্রিয় মানুষকে হারানোর যে কঠিন বেদনা, তাই তিনি প্রকাশ করেছেন কাব্যের ভাষায়। মাত্র ১২ বছর বয়সে সুফিয়া কামাল স্বামী হিসেবে পেয়েছিলেন সৈয়দ নেহাল হোসেনকে। নেহাল ছিলেন আধুনিকমনস্ক, স্বামীর উৎসাহে সাহিত্যপাঠে মনোনিবেশ করেন, শুরু করেন লেখালেখি। ১৯২৩ সালে রচনা করেন প্রথম গল্প ‘সৈনিক বধূ’, যা বরিশালের তরুণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তার সুপ্ত প্রতিভার বিকাশে নেহাল হয়ে ওঠেন সহযোগী। কিন্তু ১৯৩২ সালে নেহাল হোসেনের আকস্মিক চলে যান পরপানে। এই মৃত্যু সুফিয়ার জীবনে গভীর বেদনা আর শোক নিয়ে আসে। কিন্তু সুফিয়া কামাল মূলত শিল্পী। সৃষ্টি তার রক্তে। তাই তিনি শোকের আগুনকে শিল্পের আগুনে পরিশীলিত করে তোলেন। শোকার্ত হৃদয়ের আর্তনাদ হয়ে উঠে কবিতার পঙ্ক্তি। ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় আমরা দেখি, হৃদয়ের গভীর শোক। যেখানে বসন্তও তাকে জাগাতে পারে না। শীতের সেই দিনগুলোই সুফিয়াকে ঘিরে রাখে, আর মনে পড়ে হারানো প্রিয়কেইÑ

‘হে কবি নীরব কেন ফাগুন যে এসেছে ধরায়/বসন্তভরিয়া তুমি ল’বে নাকি তব বন্দনায়?/কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলে/দখিন দুয়ার গেছে খুলে?/বাতাবী নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল/দখিনা সমীর তার গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল।’

‘হোক, তবু বসন্তের প্রতি কেন এই তব তীব্র বিমুখতা?’/কহিলাম ‘উপেক্ষায় ঋতুরাজে কেন কবি দাও তুমি ব্যথা?’/কহিল সে কাছে সরি আসিÑ/‘কুহেলী উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসীÑ/গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে/রিক্ত হস্তে। তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতে পারি না কোনো মতে।’

এই ভুলতে না পারার বেদনা, দখিনের জানালা খুললেই শুধু তার স্মৃতি ভেসে আসা কবিকে দেয় অনন্ত প্রতীক্ষা। সাঁঝের মায়ায় সে দেখে প্রিয়র মুখ। প্রকৃতির সাজে, ঋতুর পরিবর্তনে, শীতার্ত মলিন মুখে মাঘের প্রশ্নে আর অশোক শিমুলের রক্তরাগে তিনি খুঁজে চলেন সেই প্রিয়মুখ। এই পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ ও প্রকৃতির মধ্যে কবি বিচরণ করেন সেই প্রিয় মানুষের প্রতীক্ষায়। ‘আর সে আসিবে কবে’ কবিতাটি আমরা পাই সেই গাঢ় বেদনার চিত্রÑ

‘আর সে আসিবে কবে?’ জিজ্ঞাসিল শীতার্ত মলিন মুখে মাঘ/অশোক শিমুল তার ছড়াই হৃদয়ের রক্ত অনুরাগ।/অন্তর মধুর বিন্দু মুকুলের বুকে সঞ্চারিয়াশিশির অশ্রুতে/সব শুষ্কতারে শ্যামল করিয়া/রহিল তাকায়ে।’

এই ব্যক্তিগত শোক কবির সৃষ্টিকে আরো শাণিত করে তুলেছিল, তার অবিনাশী বেদনাকে করে তুলেছিল গভীর ও মর্মস্পর্শী। এই বেদনা, এই প্রেম, এত নিবিড় যে, এখানে ব্যক্তির উপস্থিতির প্রয়োজন নেই। এখানে প্রিয় বেঁচে থাকে তার আপন ভুবনে। তার মনের গহনে। কবি তার সেই প্রিয়কে স্পর্শ করেছেন স্পর্শহীনতায় অথবা স্পর্শের ঊর্ধেŸ এই প্রেম, এটা শুধু অনুভব করা যায়, এর ধ্বনি শুধু হৃদয়ে ধারণ করা যায়Ñ

‘তুমি বেঁচে রবে আমার ভুবনে যত দিন আমি রব/যুগ যুগ ধরি প্রতিদিন আমি তোমারে ঘেরিয়া নব/রচিব মোহন মধু মিলনের বিরহ ব্যথার গান/যত ব্যথাতুর প্রাণ।’

সুফিয়া কামাল বেগম রোকেয়ার সংস্পর্শে ধন্য হয়েছিলেন। নিজেকে তৈরি করেছিলেন রোকেয়ার আদর্শে। অত্যন্ত আধুনিক মনন নিয়ে নারীর জন্য কাজ করেছিলেন। নানাভাবেই তিনি ছিলেন মানবতাবাদী আর নারী প্রগতির দূত। কিন্তু এই মানুষটিই প্রেম ও বিরহকে ধারণ করেছিলেন শৈল্পিক সুষমায়। তার কালে নারীর প্রকাশ ছিল সীমাবদ্ধ, নারী ছিল রক্ষণশীলতার নিগড়ে বন্দি। সেই সময়ে তিনি যেভাবে ব্যক্তিগত প্রেম আর বিরহের প্রকাশ ঘটিয়েছেন, তা তাকে যেমনি একজন অসাধারণ প্রেমময়ী মানবী হিসেবে পাঠকের কাছে পরিচয় করায়, তেমনি উন্মোচিত করে তার সূক্ষè আর মানবীয় শিল্পী ও কবি সত্তাকে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close