সৈয়দ নূরুল আলম

  ২৬ জুলাই, ২০১৯

সরল প্রতিমার তিলক

‘যে আদল অন্য কারো’ জাহান জলেশ^রীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। গ্রন্থটি বইমেলা ২০১৯-এ বৈভব থেকে প্রকাশিত হয়েছে। দীর্ঘ কাব্যচর্চা শেষে, কবিতার জিওগ্রাফি জেনে, স্থির বিশ্বাসের ওপর ভর করে জাহান জলেশ^রী তার প্রথম বই প্রকাশ করেছেন। যেখানে নেই বই প্রকাশের স্থূল আবেগ, তার পরিবর্তে আছে সূক্ষ্ম জীবনবোধ, ভালো লাগার মতো এক একর সবুজ জমিন এবং ভালোবাসার তৃষ্ণা, যা তার কবিতায় খুঁজে পাবে পাঠক।

কবি লেখেন, তৃষ্ণার্ত জমিন বরষা পেলে সব শুষে নেয়/আমার তেমন আদিম গন্ধ, আদিম মাটির কাম-শরীর/আদিম বুকের বাঁ-দিক ছিল/তোমার ভীষণ প্রিয় ভোরের বকুল/বুকপকেটে গুঁজে রাখার পশমগুলো আগুন হলো/ঘরভর্তি সেই গন্ধে বন্দি হয়ে এখন আমি/বাসর সাজাই/শুদ্ধ বাসর (শেকড়ের অভ্যর্থনায়)। এ কবিতা পাঠে পাঠক হিসেবে আমরাও শুদ্ধ হই। ঋদ্ধ হই। আমাদের মধ্যে একটা অন্যরকম ভাবনার জায়গা তৈরি হয়। এটাই জাহান জলেশ^রীর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য।

পরিমিতিবোধ ও সুনিয়ন্ত্রিত কাব্যভাষা একজন কবির জন্য ততটা-ই প্রয়োজন, যতটা সে নিজেকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে। স্থলযান বা জলযান যাই বলি না কেন, একবার পথ হারালে, গন্তব্যে পৌঁছানো কঠিন। একজন কবিও স্বনিয়ন্ত্রণ হারালে ডুবে যাওয়া বা ভেসে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু জাহান জলেশ^রীর ক্ষেত্রে সে আশঙ্কা নেই কারণ, পরিমিতিবোধ ও কাব্যভাষার বুনন সবটাই তার আঁচলে বাঁধা। যেমন, ছেলেবেলায় ঝকমকি রোদের সোনালুধানের মাঠ পেরিয়ে/শহুরে আমি হেঁটে যেতাম গ্রামের ইশকুলে/অপ্রাপ্তবয়স্ক আমাকে বোদ্ধা ভেবে/বড়পু বলেছিল/কোনো দিন কোনো পুরুষের চোখের গভীরে তাকাসনে/সে চোখে থাকে ব্যাধির মতো মৃত্যু/সে হবে জেনেশুনে বিষপান। কবি এখানে দক্ষ নাবিকের মতো নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। এখানেই জাহান জলেশ^রীর নিজস্বতা।

আলোচিত গ্রন্থে ছোট-বড় বায়ান্নটি কবিতা স্থান পেয়েছে। যেখানে সাতান্ন লাইনের কবিতা (মাকে) আছে আবার চার লাইনের কবিতাও আছে (শারীরিক)। একজন দক্ষ শব্দ কারিগর এভাবে তার চিন্তাকে ভাঙতে পারেন, মননের জাল ইচ্ছেমতো বিস্তার করতে পারেন, যেটা জাহানের করায়ত্ত।

কবিতায় প্রেম থাকবে, কিন্তু সে প্রেম যদি হয় ভেতর মোচড়ানো এক রক্তক্ষরণ, তখন তা হয় প্রণামী। যেমন, আমি তোমার ট্যাংকি উপচে পড়া/পানির অপচয়, মন শরীরের ক্ষয়/আর প্রতিদিনের শেষে/সব চুকিয়ে বুকিয়ে/ আমি তোমার রহমতের শেষ লোকমা/শেষ প্রসাদের ভাগ (এটি একটি নিখাদ প্রেমপত্র)।

হিউমার, আঞ্চলিক শব্দ প্রয়োগে যথার্থতা, প্রকৃতি দেখার চোখ, শব্দের নির্মেদ এসব একজন লেখক বা কবিকে শক্তভিত্তির ওপর দাঁড় করায়। যা আলোচিত গ্রন্থে সমভাবে উপস্থিত। তাই তো ‘সে যদি আগন্তুক হয়’ কবিতায় কবি লেখেন, সে হেসে হেসে গাছ হয়ে যায়/নিগ্রোর সাদা দাঁতের মতো সবুজ পাতায়/ঝলকানি মাখে আনন্দ/গাছের বুকে ঘাসফড়িঙের প্রাচীন চমক ছটফটানি/অবুঝ পাখির ডানাজুড়ে নিরুদ্দেশ পালঙ্কে/তার বালিশ ভিজে বাবলাফুলের রোদে/বুকগহিনের আঙিনাজুড়ে নতুন মাটির গন্ধ ঘুমায়/আলিঙ্গনে। এখানে প্রকৃতি যেভাবে এসেছে, একইভাবে এসেছে হিউমারÑ সে হেসে হেসে গাছ হয়ে যায়।

জাহান জলেশ^রীর কবিতা পড়তে পড়তে পাঠক কখনো ভাবতে বসবে, এটা কবিতা, না গল্প? যেমন বুমেরাং হোক কবিতা (পৃ. ৬২)। এখানে আছে প্রধান চরিত্র ‘তুমি’। আছে হাসি, কান্না, প্রকৃতি, রোদ, মেঘ বৃষ্টি, ক্লান্ত বুক, প্রিয় ঘুমমুখ। কাজেই বনফুলের দেড় পাতার গল্পের মতো, জাহান জলেশ্বরীর গল্প ভাবতে দোষ কী!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close