জিনিয়াস মাহমুদ

  ০৪ জানুয়ারি, ২০২০

ঘুঘু পাখির ছানা

এক নদীর তীরে একটি কদমগাছ ছিল। সেই কদমগাছে খড়কুটোর ছোট্ট একটা বাসা। সেই বাসাতে একজোড়া ঘুঘুপাখি থাকত। সেই পাখি দুটি একে অপরকে অনেক ভালোবাসত। একসঙ্গে উড়ত। একসঙ্গে খাবার খেত। একসঙ্গে ঘুমাত। কত কী গল্প করত। স্ত্রী পাখি কদিন পরই ডিম দেবে। এক দিন তাদের মাঝে গল্প ছিল এ রকমÑ কদিন পরে আমি ডিম পাড়ব। আর সেই ডিম থেকে সুন্দর ফুটফুটে ছানা হবে। দেখতে ঠিক আমাদের মতো। তখন আমাদের কত ভালোই না লাগবে! তাই না? পুরুষ পাখি বলে, হ্যাঁ। আমরা আমাদের ছানাদের উড়তে শেখাব। খাবার খেতে শেখাব। তাদের নিয়ে এদিক-সেদিক ঘোরব। ছানারা আমাকে বাবা বলে ডাকবে। তোমাকে মা বলে ডাকবে। আহা! তখন কত আনন্দ-ই না হবে! স্ত্রী পাখি বলে, হ্যাঁ গো, তখন আমাদের শুধু আনন্দ আর আনন্দের দিন।

এভাবেই তাদের দিন চলতে থাকে। একসময় স্ত্রী পাখি ডিম দেয়। আর সেই ডিমে সে তা দেয়। কিছুদিন পর ডিম থেকে দুটি ছানা হয়। দুটিই ছেলে ছানা। ছানা দুটি দেখতে খুব সুন্দর। পাখি দুটি তাদের ছানা দুটির সুন্দর নাম রাখে। এবার পুরুষ-পাখি স্ত্রী-পাখিকে বাসার বাইরে যেতে না করে। সারাক্ষণ ছানাদের পাশেই থাকতে বলে। আর সে গিয়ে সবার জন্য খাবার সংগ্রহ করে। এক দিন পুরুষ পাখি খাবারের জন্য সকালে বাসা থেকে বের হয়। সকাল গিয়ে দুপুর হয়। দুপুর গিয়ে রাত হয়। সে আর বাসায় ফিরেনি। স্ত্রী পাখি সঙ্গীর চিন্তায় সারা রাত ঘুমায়নি। কেন ফিরে এলো না? কোনো বিপদ-টিপদ হলো কি না? এই ভাবনাই তার মাথায় ঘুরপাক খায়। এদিকে ছানারাও খিদেয় কান্নাকাটি করছে।

পরদিন সকাল যায়। দুপুর যায়। বিকাল যায়। সেই পাখি যখন আর ফিরে আসেনি, তখন স্ত্রী পাখির বুঝতে বাকি রইল না যে সে আর ফিরে আসবে না। নিশ্চয় দুষ্টু ছেলেদের হাতে ধরা পড়েছে। এই ভেবে সে অনেক কাঁদে। মায়ের কান্না দেখে ছানারাও কাঁদে। ছানাদের কান্না দেখে মা-পাখি নিজেকে সে নিজেই সান্ত¡না দেয়, ছানাদের সামনে কাঁদলেই আর কী হবে? তাকে তো আর ফিরে পাব না। যাই, দেখি কোনো খাবার-টাবার খুঁজে পাই কি না। ছানাদের এভাবে না খাইয়ে রাখলে তারা তো মরে যাবে। তখন আমি কী নিয়ে বাঁচব? এখন তো এই ছানারাই আমার সব। ভাবতে ভাবতে বাসা থেকে উড়াল দেয়। কিছুদূর গিয়ে অল্প-কিছু খাবার পায়। তা নিয়ে ফিরে আসে। ছানাদের খাওয়ায়। পরে রাত হলে ছানারা ঘুমিয়ে পড়ে। পাখিটি আবার তার সঙ্গীর জন্য নীরবে কাঁদতে থাকে। চোখ গড়িয়ে জল পড়ে। কান্নায় যেন তার বুক ফেটে যায়। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে রাত ফুরিয়ে সকাল হয়, তা সে টেরই পায়নি। হঠাৎ একটা দোয়েল পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে তার। ছানারা তখনো ঘুমাচ্ছে। এই ফাঁকে সে খাবারের সন্ধানে বের হয়। তবে খুব একটা দূরে যায়নি। যদি ওই দুষ্টু ছেলেরা এসে তার ছানাদের ধরে নিয়ে যায়Ñ এই ভয়ে। কিছুক্ষণ পর খাবার নিয়ে ফিরে আসে। এভাবেই তাদের দিন কাটতে থাকে। দিনের বেলায় যখন কদমগাছের আশপাশে কোনো লোকজন থাকে না, তখন ঘুঘুটি তার ছানাদের নিয়ে মাটিতে নামে। তাদের উড়তে শেখায়। ছানা দুটি এখন একটু একটু করে উড়তে পারে। তবে খুব বেশি উড়তে পারে না। একটু উড়েই আবার মাটিতে পড়ে যায়।

এক দিন দুপুরবেলা মা-পাখি তার ছানা দুটিকে খাবার খাইয়ে আবার খাবার খুঁজতে যায়। আর যাওয়ার আগে তাদের বলে যায়, তারা যেন বাসা থেকে নিচে না নামে। ছানারাও মাকে বলে, ঠিক আছে মা। তোমার অনুমতি ছাড়া আমরা নিচে নামব না। পাখিটি চলে গেলে ছানা দুটি বসে বসে গল্প করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর একটি শালিকছানা উড়তে উড়তে তাদের বাসার সামনে একটি ডালে এসে বসে। তারপর বলে, একি! এই ভরদুপুরে তোমরা বাসায় বসে আছো কেন? এসো, আমার সঙ্গে এসো। আমরা ডানা মেলে উড়ব। মাটিতে নেমে খেলব। নাচব। অনেক ভালো লাগবে। এই আমাকে দ্যাখো, আমি কেমন উড়তে উড়তে তোমাদের এখানে চলে এলাম। এসো এসো। শালিকছানার কথা শুনে ঘুঘুর ছানা তার সঙ্গে যেতে চায়। কিন্তু বড় ছানা তাকে যেতে দেয় না। সে বলল, না। মা আমাদের যেতে নিষেধ করেছে। আমরা কোথাও যাব না। তা ছাড়া আমরা তো এখনো ভালোভাবে উড়তেও পারি না। যদি কোনো বিপদ হয়, তখন কী হবে? আর মা শুনলে আমাদের বকবে। শালিকছানা আবার বলে, আরে, এত ভয় পাচ্ছ কেন? আমি না হয় তোমাদের উড়তে সাহায্য করব। আর তোমাদের মা ফিরার আগেই তোমরা বাসায় চলে আসবে। আমার মাও তো আমাকে একা একা কোথাও যেতে নিষেধ করেছে। তাই বলে কি আমি বাসায় বসে রয়েছি? কতদূর থেকে উড়তে উড়তে এখানে চলে এলাম। এমন সময় আরো কয়েকটি পাখি উড়ে এসে নদীর পাড়ে হাঁটাহাঁটি করে। খেলা করে। গান গায়। নাচে। অনেকগুলো ছানাও এসেছে। এবার ছোট ছানা বাসাতে যেন আর থাকতেই চায় না। সবার সঙ্গে খেলা করতে সে নিচে নামতে চায়। কিন্তু বড় ছানা তাকে বাধা দেয়। বারবার নিষেধ করে। ছোট ছানা নিষেধ মানে না। সে শালিকছানার কথায় তার সঙ্গে নিচে নেমে পড়ে। বড় ছানা বাসা থেকে উঁকি মেরে ছোট ছানাকে ডাকতে থাকে। ছোট ছানা বড় ছানার ডাক সে কানেই নেয় না। অন্য পাখিদের সঙ্গে সে খেলায় মেতে ওঠে। তার কিছুক্ষণ পর দুটা ছেলে এসে পাখিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা চড়ুইভাতি খেলবে বলে পাখি ধরার জন্য এসেছে। তাদের দেখে পাখিগুলো কিচিরমিচির শব্দ করতে করতে এদিক-সেদিক উড়তে শুরু করে। ঘুঘুর ছোট ছানাটি কিছুই বুঝতে পারে না; হঠাৎ করে সবাই এমন শব্দ করছে আর উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে কেন? অন্য পাখিগুলো উড়ে চলে গেলেও ঘুঘুছানাকে ওই ছেলে দুটি ধরে ফেলে। ধরে দেখে যে, ছানাটি খুবই ছোট। তাই তারা এই ছানাটি নেবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এটিকে ব্যবহার করে বড় ঘুঘুকে ধরার পরিকল্পনা করে। কদমগাছের ডালে বসে বড় ছানাটি যখন দেখল, ছেলে দুটি তার ছোট ভাইকে ধরে ফেলেছে; তখন সে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে। এমন সময় মা-পাখি বাসায় ফিরে আসে। সে মাকে দেখে কান্নাজড়িত কণ্ঠে সবকিছু খুলে বলে। মা-পাখি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। তারপর সঙ্গে সঙ্গেই ছোট ছানাকে বাঁচাতে ওই ছেলে দুটির চারপাশে গিয়ে উড়তে থাকে। আর বলতে থাকে, তোমরা আমার ছানাকে ছেড়ে দাও। ওকে ধরে নিয়ে যেও না। ছানাটি খুব ছোট। এখনো ঠিকঠাকভাবে উড়তে পারে না। একা একা খেতে পারে না। আমার ছানাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। আরো কত কী বলতে বলতে ছেলে দুটির চারপাশে উড়তেই থাকে। ছোট ছানা তার মাকে দেখে মা-মা বলে চিৎকার করে ওঠে। মা আমাকে বাঁচাও! ওরা আমারে মেরে ফেলবে। এই বলে একের পর এক মাকে ডাকতে থাকে।

বড় ঘুঘুকে দেখে দুষ্টু ছেলে দুটি আনন্দ নেচে ওঠে। একজনে সেই ঘুঘুটিকে ধরার জন্য পাশেই একটা ফাঁদ পাতে। আরেকজনে তার হাতে থাকা ঘুঘু-ছানাটিকে সে এবার নদীর পানিতে ভিজিয়ে ফাঁদের একপাশে রাখে। ছানাকে ভিজায় এজন্য যে, যাতে করে ছানাটি উড়তে চাইলেও সে আর সহজে উড়তে না পারে। তারপর তারা দুজন একটু দূরে সরে যায়। ওরা দূরে সরে যেতেই ঘুঘুটি তার ছানার কাছে চলে আসে। এসে ছানাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে। তাকে আদর করে। দুজনেই কেঁদে ওঠে। পরক্ষণেই মা-পাখি বুঝতে পারে, সে ওই দুষ্টু ছেলেদের ফাঁদে আটকে পড়ে গেছে। এবার তার কান্না আরো বেড়ে গেল। ছেলে দুটি যখন দেখল, ঘুঘুটি তাদের ফাঁদে আটকা পড়েছে তখন তারা দৌড়ে এসে তাকে ধরে ফেলে। পরে ছানাকে সেখানেই ফেলে রেখে মা-পাখিটিকে নিয়ে তারা চলে যেতে থাকে। মা পাখির দুই চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ে। মাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে দেখে বড় ছানাটি উড়ে তাদের কাছে আসতে গিয়ে ধপাস করে মাটিতে পড়ে যায়। তারপর কোনোমতে ছোট ভাইয়ের কাছে আসে। এবার মা মা বলে চিৎকার করতে থাকে ছানা দুটি। অপলক চোখে তাকিয়ে দেখে তাদের মাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সেই করুণ দৃশ্য। ছানা দুটি তাদের মায়ের জন্য অনেক কাঁদে। পরে ছোট ছানা কাঁদতে কাঁদতে বড় ছানাকে বলে, ভাই! ভাই রে! আমরা কি আমাদের মাকে আর কোনোদিন ফিরে পাব না? বড় ছানা বলে, জানি না রে ছোট। দুষ্ট ছেলেদের হাতে মা যখন ধরা পড়েছে, তখন কি আর এই ছেলেরা মাকে ছাড়বে! নিশ্চয় তারা আমাদের মাকে খেয়ে ফেলবে। এই বলে সে সজোরে কেঁদে ওঠে। কিছুক্ষণ পর বড় ছানা আবার ছোট ছানাকে বলে, তোর জন্য আজ আমরা আমাদের মাকে হারালাম। তুই যদি ওই শালিকছানার কথায় নিচে না নামতি। মায়ের কথা মানতি, আমার কথা শুনতি, তাহলে এই ছেলেরা তোকে ধরতও না, আর মাও এখন নিচে নেমে আসত না। তাদের ফাঁদেও আর আটকা পড়ত না। মা তো শুধু তোকে বাঁচানোর জন্যই এখানে এসেছিল। এসেই ওদের ফাঁদে আটকা পড়ে যায়। তোকে আমি বারবার নিচে নামতে নিষেধ করেছিলাম। তুই আমার কথা শুনিসনি। ছোট ছানাটি তার ভুল বুঝতে পারে। সে বলে, হ্যাঁ, ভাই। মায়ের কথা না মেনে আমি ভুল করেছিলাম। আমি যদি তখন মায়ের কথা মানতাম, তোর কথা শুনতাম, ওই শালিকছানার কথায় নিচে নেমে না আসতাম; তাহলে এখন মাকে এভাবে হারাতে হতো না। আমাদের মা আমাদের কাছেই থাকত। এক দিন আমাদের বাবা আমাদের জন্য খাবার আনতে গিয়ে আর ফিরেনি। আজ আমরা মাকেও হারালাম। এখন আমাদের আপন বলতে আর কেউ রইল না। এসব বলতে বলতে সেও সজোরে কেঁদে ওঠে। কাঁদতে থাকে বড় ছানাও। তাদের কান্না ছড়িয়ে পড়ে আকাশে-বাতাসে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close