আঞ্জুমন আরা
মেছো পেতনি
একটি কৃষিপ্রধান গ্রামে বাস করত তিন ভাই। লালু, কালু ও ধলু। তিনজন মানিকজোড়। একসঙ্গে খাওয়া একসঙ্গে ঘুম। কখনো ওরা আলাদা হয় না। ধলু বড়। লালু ও কালু যমজ। লালু ও কালু, ধলুকে মিঁয়াভাই বলে ডাকে। আবার লালু, কালুকে ডাকত মেঝো ভাই। এরা সবার আদরের ছিল। তারা ছিল তারুণ্যের উদ্দীপনায় ভরপুর। কিন্তু কখনো কারো ক্ষতি করেছেÑ এমন কথা কেউ বলতে পারবে না। বরং সবার উপকারে ছিল নিবেদিতপ্রাণ। লালু খুব ভালো পুঁথি পাঠ করত। শীতের রাতে খেজুরের রস দিয়ে রান্না করা পায়েস খাওয়ায়, তাদের সুনাম ছিল গাঁয়ে। তাই আত্মীয়স্বজন যুবকরাও তাদের সঙ্গে এসে এসব উদ্দামতায় যোগ দিত।
লালু এক দিন ধলুকে বলল...
মিঁয়াভাই চলেন আমরা বিলে মাছ ধরতে যাই। কালুর অনুমতি নিতে হলো না নৌকা, জাল ও খাবার নিয়ে তিন ভাই মাছ ধরতে বিলে গেল। যেতে যেতে রাত হয়ে গেল। আর শুরু হলো মাছ ধরা। লালু নৌকার বৈঠা হাতে হাল ধরে রইল। ধলু জাল ছুড়ে মারছে ও মাছ ধরছে। আর জাল ভরে মাছ উঠছে। কালু শুধু মাছ কুড়িয়ে নৌকার পাটাতনের নিচে রাখছে। আর কতক্ষণ পরপর নৌকার পানি সেচে নৌকা হালকা করছে। নৌকা প্রায় ভরে এলো মাছে। রাত যখন গভীর হলো চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার আর অন্ধকার। কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। ঝিলের মাঝে শুধু তিন যুবক। তাদের নায়ে মিটমিট করে জ্বলা হারিকেনটা ধপ করে নিভে গেল। কালু চিৎকার করে বলে উঠল...
মিঁয়াভাই হারিকেন তো নিভে গেল।
সে বলল...
তোর কাছে না দিয়াশলাই আছে জ্বালা।
কিন্তু তার কাছে দিয়াশলাই নেই বলে কুপি জ্বালাতে পারল না। লালু তার কোমরে গুঁজে রাখা দিয়াশলাইটি কালুর হাতে দিল। কিন্তু ভয়ে তার হাত থেকে ওটা নৌকার মাঝে জমে থাকা পানিতে পরে গেল আর আগুন জ্বালানোর অনুপযোগী হয়ে গেল। কালু এবার ভয় পেয়ে চিৎকার দিয়ে বলে উঠল...
মিঁয়াভাই দিয়াশলাই তো ভিজে গেছে এখন কী করব?
কালুর কথাশুনে ধলু একটা ভেংচি দিয়ে বলে উঠল...
এটা তুই এটা কি করলি? এখন বাতি জ্বালাব কী করে?
আর একটি বারও জলে জাল পরল না। ধলু, কালুকে বলল...
চল এবার ফেরা যাক আর মাছ ধরা যাবে না।
লালু শক্ত হাতে বৈঠা বাইতে শুরু করল এবং নৌকা ছুটে চলল, কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারল না কোনদিকে যেতে হবে। নায়ের সামনে বসে জোরে বৈঠা টানছে ধলুও।
কিছুক্ষণের মধ্য কালু চিৎকার দিয়ে উঠল...
মিঁয়াভাই...
সে চমকে গিয়ে পেছনে তাকাল আর মনে মনে দোয়া পড়তে শুরু করল। যা ভেবে ছিল তাই। একটা আগুনের দলা লাফ দিয়ে নৌকায় উঠল আর মাছ নিয়ে জলে পড়ে গেল। কালু এবার চিৎকার দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ধলু বলে উঠল...
খবরদার নড়বি না। তাহলে নৌকাডুবে তিন ভাইই মারা পড়ব।
লালু সব দেখেও নির্বাক। আরো শক্তি দিয়ে বৈঠা বাইছে। এবার দুটি আগুনের দলা উঠল। তারপর তিনটি পাঁচটি অনেকগুলো। ক্রমেই বাড়তে থাকে আগুনের দলার সংখ্যা। লালু এবার চিৎকার দিয়ে উঠল...
কে আছো বাঁচাও বাঁচাও।
তিন ভাই মিলে চিৎকার দিল ও দোয়া পড়া শুরু করল।
কিন্তু কেউ এগিয়ে এলো না এই নির্জন জলাধারে। সেখানে কেউ ছিল না তাদের সাহায্য করার মতো। দুই ভাই কতক্ষণ নৌকা বাইল তার হিসাব মিলানোর সময় হয়নি।
ঘুটঘুটে আঁধার কেটে একসময় ফজরের আজান পড়ল। চারদিক ফর্সা হলো। তারা নিজেদের ঝিলের মাঝে মাছহীন নৌকায় আবিষ্কার করল। ধরে প্রাণ ফিরে এলো। আর তিন ভাই মনের সাধ মিটিয়ে কাঁদল কতক্ষণ। তারপর বাড়ির দিকে নৌকা চালানো। দুই ভাই চার হাতে বৈঠা টেনে বাড়ি ফিরতে দুপুর হলো। তিন ভাইয়ের ভীতিপূর্ণ রক্তলাল চোখ দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল। মুরব্বিরা ছুটে এলো আর এটা সেটা জিজ্ঞেস করতে থাকল।
কী হয়েছে? কী হয়েছে?
উত্তর জানা গেল।
নৌকায় মেছো পেতনি পড়েছিল।
তিন ভাই একসঙ্গে জ্বরে ভুগেছে দীর্ঘদিন। আর বহুকাল ধরে এই মেছো পেতনির গল্প দশ গাঁয়ের লোকে বলাবলি করেছে। সেই মেছো পেতনির গল্প শুনেছে তাদের নাতি-নাতনিরাও।
"