তুফান মাজহার খান

  ২৪ আগস্ট, ২০১৯

সফরসঙ্গী ছাগল

বয়স তখন ১২ কী ১৩ হবে। তখনকার কোরবানি ঈদগুলোতে দেখতাম সবাই সবার কোরবানির মাংস আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, ফকির-মিসকিনদের দিয়ে, নিজেরা খেয়ে সর্বোচ্চ তিন দিনের মধ্যে শেষ করে ফেলত। সে রকমই এক ঈদে কোরবানির মাংস ফুফুর বাড়িতে পাঠানোর দায়িত্ব পড়ল আমার ঘাড়ে। পরিবারে আরো দু-চারজন সদস্য থাকা সত্ত্বেও আমাকে যেতেই হবে। কারণ, সবাই মাংস নিয়ে বিভিন্ন আত্মীয় বাড়ির উদ্দেশে বেরিয়ে গেছে। তখনকার দিনে ফ্রিজের এত প্রচলন না থাকার কারণে দিনে দিনেই মাংস বিলি-বণ্টন করে ফেলতে হতো। সেদিন গরু জবাইয়ের পর কেটে-কুটে প্রস্তুত করতে করতে প্রায় আসরের ওয়াক্ত হয়ে এলো। মা মাংসের একটা পোঁটলা আমার হাতে দিয়ে বলল, যাও এটা তোমার ফুফুর বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসো। ফুফুর বাড়ির রাস্তাটা আজকালের মতো এত পাকাপোক্ত ছিল না। প্রায় ১৫-২০টা ধানিজমি, কিছু কাঁচা বাড়ি, কবরস্থান, একটি পরিত্যক্ত বাড়িসহ মেঠোপথের রাস্তাটি ছিল মোটামুটি দুর্গম ও হাঁটাপথ। আবার দূরত্বও খুব কম নয়, প্রায় মাইল দেড়েক হবে। যাহোক, যেতে তো হবেই। পোঁটলাটি নিয়ে রওনা হলাম। মা পেছন থেকে ডেকে বলে দিল, যেন সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসি।

আমি হাঁটতে থাকলাম। কিছুদূর যেতেই দেখি একটি মাঠে কিছু গরু, ছাগল ঘাস খাচ্ছে। আশপাশের বাড়িঘর বা জনমানবের চিহ্নমাত্রও নেই। আরেকটু এগিয়ে যেতেই অনুভব করলাম পেছনে কিছু একটা আমাকে অনুসরণ করছে। ঘুরে দেখি গলায় রশিবিহীন একটা ছাগল। আমি ছাগলটিকে তাড়িয়ে দিলাম। ছাগলটি দৌড়ে ঝোঁপের দিকে চলে গেল। আমি স্বাভাবিকভাবেই হাঁটতে থাকলাম। কয়েকটি ধানখেত, বাড়িঘর পার হলাম। পেছনে তাকানোর প্রয়োজনবোধ করলাম না। কিন্তু যখন সেই পরিত্যক্ত বাড়িটি পার হলাম, তখন আবার পেছনে ম্যা ম্যা ডাক শুনলাম। ঘুরে দেখি সেই ছাগলটিই আবার পেছন পেছন আসছে। এবার কিছুটা রাগ নিয়ে একটা ডাল ভেঙে এটাকে তাড়া করলাম। ছাগলটি উল্টোদিকে ভোঁ-দৌড় দিল। আবার হাঁটতে লাগলাম। এবার আমি নিশ্চিন্ত যে, ছাগলটি আর আমার পেছন পেছন আসছে না। কিন্তু আরেকটু আগাতেই আবার পেছনে ছাগলটির অস্তিত্ব অনুভব করলাম। সঙ্গে কিঞ্চিৎ ভয়ও কাজ করছে। কিন্তু এবার আর কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে সোজা হাঁটতে লাগলাম। এক হাঁটায় ফুফুর বাড়ির পেছনে। গিয়ে দেখি ফুফু বাড়ির পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই ফুফু বলে উঠল, আমার বাবা আসছে, আমার বাবা। বলতে বলতে আমাকে টেনে বাড়ির ভেতর নিয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম, ফুফু এই ছাগলটা আমাদের বাড়ির কাছে থেকে পেছন পেছন চলে এসেছে। কার ছাগল জানি না। ফুফু তো শুনেই অবাক। বলল, বলো কী! আমি বললাম, জি ফুফু। ফুফু বলল, আচ্ছা তুমি বাড়ির ভেতরে এসো, দেখি ছাগল কী করে। ছাগলও বাড়ির ভেতরে ঢুকল। উঠানে বসে থাকল। আমি নাশতা করলাম, ফুফুকে বাড়ির খবরাদি জানালাম। প্রায় আধ ঘণ্টা বসে থাকার পরও ছাগলটি উঠান ছেড়ে কোথাও গেল না।

আমি ফুফুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। ফুফু অবশ্য আসতে দিতে চাচ্ছিল না, কিন্তু প্রথমত. মা চলে যেতে বলেছে তাই চলে যাব আর দ্বিতীয়ত. যে ছাগলটা আমার পিছু নিয়েছে তারও একটা সুরাহা করতে হবে। তা না হলে ছাগলটার মালিক হয়তো এটাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হবে। ছাগলটাও পেছন পেছন আসতে থাকল। আমাকে যতক্ষণ দেখা গেল ঠিক ততক্ষণ ফুফুও দাঁড়িয়ে রইল। আসার সময় অবশ্য ছাগলটা একটু তিড়িংবিড়িং করছিল। আমি একটু ডেকে ডেকে নিচ্ছিলাম। কেননা, আমি তো জানি যে, ছাগলটা আমার পেছন পেছনই এসেছে। এখন যদি এটাকে না নিয়ে যাই, তাহলে নিজের বিবেকের কাছেই দোষী বনে যাব।

ততক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। একটু পরই মাগরিবের আজান পড়বে। এমন সময় একটা রশিবিহীন ছাগলকে আয় আয় বলে ডেকে নিচ্ছি। এটা অবশ্য খুব সহজ বিষয় নয়। নানাজন নানা রকম ভাবতে পারে। দু-একজন তো ডেকে পুরো বৃত্তান্ত শুনেই ছাড়ল। যাহোক, অবশেষে ছাগলটা নিয়ে সেই মাঠের কাছে চলে এলাম, যেখান থেকে যাওয়ার সময় এটা আমার পিছু নিয়েছিল। এখানে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবলাম যে, কী করা যায়। তারপর মনে হলো, আরেকটু সামনেই একটা বাড়ি আছে যেখানে জিজ্ঞেস করলে হয়তো কোনো ব্যবস্থা হতে পারে। চিন্তা অনুযায়ী গেলাম সে বাড়িতে। ছাগলটি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করতেই বাড়ির মানুষ বলে উঠল, এটা তো মানিকের মায়ের ছাগল। ইতোমধ্যে ছাগলের মালিক খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছিল। নিয়ে গেলাম মানিকের মায়ের কাছে। মানিকের মা ছাগলের বৃত্তান্ত শুনে আমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাতে লাগল। বলল, তোমার সঙ্গে এমন হয়েছে বলে হয়তো ছাগলটা খুঁজে পেয়েছি। অন্য কেউ হলে হয়তো এমনটা করত না। আমি বললাম, না না। কী যে বলেন, আমার একটা দায়িত্ববোধ আছে না? কিন্তু আমার একটা পরামর্শ, আপনি ছাগলটা এভাবে ছেড়ে রাখবেন না। রশি দিয়ে বেঁধে রাখবেন। তা না হলে অচিরেই ছাগলটা হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। মানিকের মা বললেন, হ্যাঁ বাবা, আমি এক্ষুনি ছাগলটির গলায় রশি লাগাচ্ছি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close