আহমদ আবদুল্লাহ

  ০৬ এপ্রিল, ২০১৯

স্মৃতিকথা

মেঘনা নদীর তীর। পুরান বাজারের ঠিক পশ্চিমে মেঘনা আর উত্তরে ডাকাতিয়া নদী। সারা বছর ছলছল করে বয়ে চলে নদীর পানি। উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে। বর্ষা এলে দুকূল উপচে ওঠে পানি। মাঠঘাট ডুবিয়ে দেয়। কখনো কখনো বাড়িঘরে ঢুকে পড়ে।

এই নদীর পশ্চিমপাড়ে খানিকটা দূরে আমাদের বাড়ি। এরই পাশে সাদিয়াদের বাড়ি। ঠিক আমাদের বাড়ির সম্মুখে। মেঘনা নদীর পূর্ব দক্ষিণে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। পৌষ-মাঘ মাসে নদীর দুপাড়ে দুটি ইরি ধানের সবুজ মাঠের দিকে তাকালে মন পাখি ওড়ে যায়। ওপরে নীলাকাশ। নিচে সবুজের বিপুল বিস্তার। যেন সবুজ সমুদ্র। সে সবুজ দেখতে কী যে ভালো লাগে! আমি আর সাদিয়া কখনো মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে ভাবি। আহ! আমরা যদি পাখি হতাম! তা হলে এই মাঠের সবুজের ওপর দিয়ে বাতাসে সারা দিন ডানা মেলে ওড়ে বেড়াতাম। আকাশের ওই অথই নীল আর মাঠের অনন্ত ঘন সবুজ গায়ে মেখে নিতাম। ইশ! কতই না ভালো লাগতো।

প্রকৃতির প্রতি মায়া ছিল আমাদের দুজনের বেশ। গাছগাছালি, নদীবন্দর, পাহাড়-পর্বত আর আকাশ নিয়ে কবিতা লেখা হতো নিয়মিত। আবৃত্তিতে আমরা ছিলাম সবার নয়ন কেড়ে নেওয়ার মতো। ক্লাসে কিংবা স্কুলের যেকোনো অনুষ্ঠানে আমাদের ডাক ছিলো দেখার মতো। সবার মুখে একটাই নাম আহমদ আর সাদিয়ার মুখে কিছু শুনতে চাই। আমরাও নিঃস্বার্থভাবে সবার মাঝে আনন্দ ঢেলে দিতাম, সর্বস্ব বিলিয়ে। তাই আমরা দুজন ছিলাম সবার মধ্যমণি। আমাদের দুজনের জুটি সবার মনে ঈর্ষা জন্মাতো বরাবরের মতোই।

রাতে মেঘনা নদী আরেক রূপ ধারণ করে। আকাশে অসংখ্য জ্বলজ্বল করা তারার মেলায় মায়ের ডাগর মুখের মতো শুভ্র চাঁদ হেসে ওঠে। ধবল জোছনায় আকাশ মাঠ আর গ্রাম একাকার হয়ে যায়। বর্ষার সময় নদীতে অনেক নৌকা চলে। এপার-ওপার ঘাটে নৌকার টানাটানি লেগে যায়। কেউ হাট-বাজারে যায় আসে। কেউ আত্মীয় বাড়ি যায় আসে। কেউ নৌকায় মাছ ধরে। গোসল করে। সাঁতার কাটে। ঘাটে ঘাটে নরনারী। ছেলে মেয়ে। ডাকাডাকি। কোলাহল।

সেদিন আমি আর সাদিয়া হাঁটছিলাম আনমনে, সহসা আমাদের দৃষ্টি আজাদ মাঝির দিকে। আমার চোখে বিন্দু বিন্দু পানি এসে পড়েছিল সে সময়টায়। তাদের দুঃখ আর কষ্টের কথা প্রায়শই আমি আর সাদিয়া ভাবতাম। স্কুলে যাওয়ার পথে আব্বু যা টাকা দিত, আমি আর সাদিয়া সবগুলো সেই আজাদ মাঝিকে দিয়ে দিতাম। নিজেদের মাঝে কেমন যেন এক ধরনের তৃপ্তি অনুভব করতাম। যাকে স্বর্গীয় তৃপ্তিও বলা যেতে পারে।

আজাদ মাঝি খেয়া পারাপার করে। আজাদ মাঝিকে সবাই আজাদ বলেই ডাকে। বর্ষাকালে দুকূলে লোকজনের দারুণ ভিড় হয়। হাঁকাহাঁকি শুরু হয়ে যায়। আজাদ মাঝির দাম বেড়ে যায়। দুপাড় থেকে ডাক পড়ে : ‘আজাদ তাড়াতাড়ি করে নাও ভিড়াও...।’

আজাদ মাঝির ভাঙা নাও। সবসময় তলা দিয়ে ঝিরঝির করে পানি ওঠে। কতক্ষণ পানি না সেচলে নাও আধা ডোবা হয়ে যায়। আজাদ মাঝির কচি ছেলে রাহি। সে সারাক্ষণ পানি সেচে। একটু বসে জিরোবারও সময় পায় না।

নদীর তীরেই আজাদ মাঝির বাড়ি। বাড়ি মানে পাতায় ছাওয়া একটা ছোট্ট ঘর। ঘরের সামনে একটা লাউয়ের জাংলা। পেছনে কয়টা ভেন্নাগাছ।

আজাদ মাঝির বউ ছমাস আগে মারা গেছে জ্বরে। ঘরে ১০ বছরের মেয়ে পারুল। আজাদ মাঝির পরিবারে এখন তিনটি প্রাণী। পারুল, রাহি আর আজাদ মাঝি নিজে।

বর্ষাকালে আজাদ মাঝিকে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয়। একটা ছেঁড়া ময়লা লুঙ্গি কোমরে জড়িয়ে মাথায় গামছা বেঁধে নাও যায় আজাদ। কোনো কোনো সময় যাত্রীদের ডাকাডাকিতে দুপুরের খাবারও খাওয়ার সময় পায় না। খেয়া বন্ধ হলে সে অভাবে পড়ে। তখন বাঁশের কাজ করে। কুলো বানায়, খাঁচি বানায়। এদিকে পারুল দুটো ছাগল পালে। দুমুঠো খেয়ে তাদের দিন চলে যায়। খাবার না থাকলে উপোস থাকে। আজাদ কাউকেই তাদের দুঃখের কথা কয় না। বলে লাভ কি! কেউই তো ধারকর্জ দেয় না। সবাই জানে ধারকর্জ দিলে সে কোনো দিন শোধ করতে পারবে না। তাই আজাদও কারো কাছে হাত পাতে না।

সমাজে তো কম মানুষ নেই। আজাদ মাঝির বউ মারা গেল মাত্র দুদিনের জ্বরে। জ্বর কঠিন ছিল না। রাহিকে নিয়ে খেয়া বাইতে গিয়েছিল আজাদ। পারুল ছাগল নিয়ে মাঠে। সে বিকেলে বাড়ি এসে দেখে মা মারা গেছে। হয়তো একটু খাবার জন্য কত ছটফট করেছে। মৃত্যুর আগে হয়তো তাদের কত ডেকেছে...

পারুল, কই গেলি! পানি দে... পারুল, আমার রাহি কই? তর বাপ কই? ওদের ডাইকা আন...

কে ডেকে আনবে কাকে? কে দেবে পানি। কেউ তো কাছে ছিল না। আজাদ মাঝি সারা দিন নাও বায়। সে তার বউয়ের মুখে মরণকালে এক ফোঁটা পানি দেবে কীভাবে? যে রাহি সারা দিন নায়ের পানি সেচে ফেলে, সেও তার মায়ের মুখে এক ফোঁটা পানি দিতে পারেনি। কত দুঃখ ও শোক যে ওদের বুকে, তা আল্লাহ ছাড়া দুনিয়ার আর কেউ বুঝে না।

পারুল বিকেলে ছাগল নিয়ে বাড়ি এসে মাকে মরা দেখে দৌড়ে গিয়ে বাপের কাছে কেঁদে কেঁদে খবর দেয়। পারুলের কান্না এপার-ওপারের যাত্রীরা সবাই শুনে কেউ একটু উহু-আহাও করলো না। কেউ রাহি আর পারুলকে সান্ত্বনাও দিলো না। আজাদ দৌড়ে বাড়ি গেল। রাহিও কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি গেল। দুপারের লোকজন বলে উঠলো...

আজাদের বউ মরে বিপদে ফেললো। এখন আমাদের পারাপার করবে কে?

আজাদ ঘরে গিয়ে দেখে তার বউ মরে একেবারে ঠান্ডা হয়ে আছে। শরীরে জ্বরবালাই নাই। ক্ষুধার যন্ত্রণা নেই। সারা জীবন সেসব দুঃখ কষ্ট হজম করেছে। ছেঁড়া কাপড় তালি দিয়ে পরেছে। নতুন কাপড়ের দাবি করেনি কোনো দিন। কখনো কারো প্রতি অভিযোগ করেনি। এখনো অভিযোগহীন শান্ত নীরব সেই মুখ।

আজাদ মাঝি এই সমাজের একজন মানুষ। তা সে যত ছোট, তুচ্ছই হোক। চারদিকে কত মানুষের আনাগোনা। কিন্তু কেউ সান্ত্বনা বা সহানুভূতি দেখাতে এলো না। নিজের বুকের কষ্ট চেপে রেখে আজাদ ছেলেকে বোঝায়...

কান্দিস নারে পোলা। কানলে তো তোর মায় আর ফিরা আইবো না। পারুলকে বোঝায়...

বেটি, কান্দিস না। কাইন্দা কি করবি! যে গেছে হে আর ফিরা আইবো না। কাইন্দা কাইন্দা আর দুঃখ বাড়াইস না। অই পথে সকলেরই যাইতে হইবো...

পারুল আর রাহি বোঝে, বাবা মিছা কতা কয়নি। কেঁদে আর মাকে পাওয়া যাবে না। শুধুই দুঃখ বাড়বে। তাই আর কাঁদে না। প্রতিদিনের মতো কাজের রুটিনমতো আজাদ মাঝি নদীতে খেয়া বায়। রাহি ভাঙা নায়ের পানি সেচে। পারুল সকালে ছাগল নিয়ে মাঠে যায়। আজাদ মাঝি যে রাতে ছেলে মেয়ে নিয়ে দুমুঠো খেতে পারে, শরীরটা ভালো থাকে। তারপর ছেলে মেয়ের পাশে শুয়ে গান গায় :

নদীরে রে রে

জীবন ভইরা বাইলাম নাও

তার কূলকিনারা পাইলাম না

নদীরে রে রে...

জীবন ভইরা দেখলাম শুধু

কিছু বুঝলাম না

ভবের বাজারে আইসা ভবের

কানো ভাব বুঝলাম না

নদীরে রে রে...

আমি আর সাদিয়া প্রতিদিন কূলে দাঁড়িয়ে আজাদ মাঝিকে দেখি আর ভাবি। ওদের দুঃখ কষ্ট মনের মধ্যখানে লাগে। মাঝে মাঝে আমাদের পুরোটা সময় ওদের ভাবনায় কেটে যায়। আমার আর সাদিয়ার সেই ভাবনাগুলো স্মৃতিপটে বারবার নাড়া দিয়ে ওঠে। ভেসে আসে আজাদ মাঝি, পারুল আর রাহির বৈচিত্র্যময় দুঃখে ভরা জীবন সংসার। তার কোমরে পেঁচানো ছেঁড়া লুঙ্গি। মাথায় একখন্ড তেনা। এদিকে রাহির পরনে হাফপ্যান্ট। উদন গতর। ওরা গ্রীষ্মকালে রোদে পোড়ে। ঘরমে ঘামে। বর্ষা-বৃষ্টিতে ভিজে নাও বায়। পানি সেচে। লোকজন পারাপার করে...।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close