আরাফাত শাহীন

  ০৯ মার্চ, ২০১৯

পাখির বাসার খোঁজে

বাড়ির দক্ষিণ পাশে মস্ত বড় পুকুর। পুকুরপাড়ে কায়দা করে বাঁশ দিয়ে মাচাং তৈরি করা হয়েছে। বাবার সঙ্গে মিলে রাজু ও তার ছোট বোন পুতুল এটা তৈরি করেছে। গ্রামে গরম পড়তে শুরু করেছে। বাবা বলেন, স্কুল থেকে ফিরে এসে দুপুরবেলা মাচাংয়ের ওপর বসবে। দক্ষিণ দিক থেকে ঝিরিঝিরি বাতাস এসে মনটা একদম তাজা করে দিয়ে যাবে। বুঝলে? জি বুঝেছি। আচ্ছা আব্বু, শীতকালে বাতাস উত্তর দিক থেকে আসত আর এখন দক্ষিণ দিক থেকে আসছে। কেন এমন হয়? প্রশ্নটা করল পুতুল। ওর জানার বেশ আগ্রহ। পুতুলের প্রশ্ন শুনে বাবা মুচকি হাসলেন। তারপর বললেন, দারুণ একটা প্রশ্ন করেছো মা। বাতাসের ধর্মই তো এমন। বাতাস সব সময় উচ্চচাপ অঞ্চলের দিক থেকে নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়। গরমের সময় উত্তর দিকে বায়ুর চাপ কম থাকে। তাই বাতাস ওদিকেই ছুটতে থাকে। বুঝেছো? দুজনই মাথা নেড়ে সায় দিল। পুতুল বলল, বুঝেছি। বাবা বললেন, বড় ক্লাসে ওঠো, তখন আরো ভালো করে জানতে পারবে সবকিছু। এমন নানা রকম গল্প করে ওরা মাচাংয়ে বসে। ওদের বেশ ভালোই লাগে।

রাজু এখন মাচাংংের ওপর বসে আছে। ওর হাতে একটা কাচের বয়াম। সেটা আচারে ভর্তি। চালতার আচার। দেখলেই যে কারো লোভ হবে। রাজু মাচাংয়ের ওপর বসে মনের সুখে আচার খাচ্ছে আর পা দোলাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে ভীষণ আনন্দে আছে সে। কি রে রাজু, যাবি না? প্রশ্নটা করল সজল, রাজুর সবচেয়ে কাছের বন্ধু। রাজুর সকল কর্মের একমাত্র সঙ্গী। কোথায় যাব? তাচ্ছিল্যের স্বরে প্রশ্ন করল রাজু। মনে হচ্ছে সজল তাকে প্রশ্নটা করে বড় অন্যায় করে ফেলেছে। তোর মনে নেই? সবকিছুই ভুলে যাওয়া লাগবে? সজল রাগ দেখাল বেশ। রাজু সচকিত হয়ে উঠল।

দেখছিস না কেমন আচার খাচ্ছি। এমন সময় ঝামেলা কার ভালো লাগে বল দেখি? নে, তুইও আচার খা। রাজু আচারের বয়াম সজলের দিলে এগিয়ে দিল। সজল হাপুস করে হাত ডুবিয়ে তুলে নিল বেশখানিকটা। তারপর মনের সুখে খেতে লাগল। রাজু প্রশ্ন করল, কোথায় যেন যাওয়ার কথা বলছিলি! সজল ঘুরে বসল। তারপর লম্বা একটা হাসি দিয়ে বলল, একটার সন্ধান পেয়েছি। কিসের কথা বলছিস? আকাশ থেকে পড়ল রাজু। ওর ভাব দেখে ক্ষেপে গেল সজল। সে রাগি গলায় বলল, পাখির বাসা। তুই এত ভুলোমনা কেন রে? তাই বল। আমি সত্যিই ভুলোমনা। চল্ তাহলে যাওয়া যাক। এখন এত তাড়া দেখাচ্ছিস কেন? আচারটা একটু ভালোমতো খেতে দে। আচার পরে এসে খাস; ফুরিয়ে তো আর যাচ্ছে না! রাজু তাড়া দেখিয়ে বলল। তোমার পাখির বাসা কি ফুরিয়ে যাচ্ছে শুনি?

যাবে না আবার! ময়না, গোপিত, ছোটনÑ এরা যদি একবার দেখতে পায় তাহলে কি আর আস্ত রাখবে! বাসাসুদ্ধ ভেঙে নিয়ে যাবে না! শঙ্কা জেগে উঠল রাজুর কণ্ঠে। সজল ওকে অভয় দিয়ে বলল, ওরা খুঁজে পেলে তো! অমন মগডালে ওদের নজর গিয়ে পৌঁছালে তো! ওরা কেউ দেখতেই পাবে না। সত্যি বলছিস তো! রাজুর বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হয়। একদম সত্যি। শতভাগ খাঁটি। বেশ জোরের সঙ্গে বলল সজল। রাজুর ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। এবার ওর দুটো পাখির ছানা চাই-ই চাই।

দুই বন্ধু রাজু ও সজল সব সময় একসঙ্গে থাকে এবং নানা কিসিমের কাজ করে থাকে। তাদের সবচেয়ে প্রিয় কাজ হলো পাখির বাসা খুঁজে বের করা। তারপর সেই বাসা পাহারা দিয়ে রাখা, যাতে কেউ পাখির ছানা বা ডিম নষ্ট করতে না পারে। কারণ ময়না, গোপিত আর ছোটন পাখির বাসা খুঁজে পেলে ছানা ধরে নিয়ে গিয়ে বাজারে বিক্রি করে অথবা খেয়ে ফেলে। ওরা পাখিকে অনেক বেশি ভালোবাসে; নিজেদের যতটা বাসে। একবার ভয়ানক ঝড় বয়ে গিয়েছিল গায়ের ওপর দিয়ে। অমন ভয়ংকর ঝড় ওরা কেউ জীবনে দেখেনি। গাছের ডালপালা ভেঙে নিচে পড়ে স্তূপ হয়েছিল। সজল এসে খবর দিল। রাজু সর্বনাশ হয়ে গেছে।

কী হয়েছে রে? ভারী উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠে রাজু। এমনিতেই ঝড়ের তান্ডবে সবকিছু খানখান হয়ে গেছে। ঝড়ে একটা বাসা ভেঙে পড়ে আছে নিচে। মা পাখিটা বাসার চারদিকে ডেকে ফিরছে। সজল বলল। তুই বাসাটা তুলে দিসনি কেন? রাগ দেখিয়ে বলল রাজু। তার ধারণা, সজল বাসাটা তুলে না দিয়ে ভারি অন্যায় করেছে।

সজল জবাব দিল, আমি একা একা পারলে তো! গাছের ডালের নিচে চাপা পড়ে রয়েছে। তুলতে দুজনের দরকার হবে। দুজন মিলেও পারব কি না সন্দেহ আছে। বলিস কিরে! তাড়াতাড়ি চল। যদি বাসায় ছানা থাকে তাহলে তো খুব কষ্ট পাবে তারা। চল তাহলে। দুই বন্ধ অনেক কষ্ট করে পাখির বাসাটা ডালপালার নিচ থেকে বের করে আনল। তবে তাতে বিশেষ লাভ হলো না। যা ঘটবার তা আগেই ঘটে গেছে। বাসায় ফুটফুটে দুটো ঘুঘু পাখির ছানা ছিল। দুটোই মারা গেছে। মা পাখিটা তখনও চারপাশে ঘুরে ঘুরে ডাকছে। রাজুর মনে হলো, পাখিটা ডাকছে না, কাঁদছে। রাজু কেঁদে ফেলল। সব দোষ গিয়ে পড়ল সজলের ওপর। সে আগে দেখেও কেন উদ্ধার করতে পারেনি! রাগ করে সে সজলের সঙ্গে দুদিন কথা পর্যন্ত বলেনি। পরে অবশ্য রাগ পড়ে গেলে ও-ই গিয়ে সজলের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিল।

রাজুর এবার শখ হয়েছে দুটো ময়না পাখির ছানা এনে পুষবে, তাদের কথা বলা শেখাবে। এ জন্য সে টানা কয়েকদিন পরিশ্রম করে একটা খাঁচাও তৈরি করেছে। ভারি সুন্দর হয়েছে দেখতে খাঁচাটা। সজলকে আগেই বলে রেখেছিল, যদি কোনো ময়নার বাসার খোঁজ পাওয়া যায় তাহলে সে যেন তাকে জানায়। সজল তাই খোঁজ নিয়ে রাজুর কাছে এসেছে। বাসায় ছানা আছে তো? তুই দেখেছিস? প্রশ্ন করল রাজু। বাসা অনেক উঁচুতে। আমি অত উপরে উঠতে পারি নাকি? কী বলছিস! তাহলে কীভাবে বুঝলি ওটা ময়নার বাসা? কী যে বলিস! এতদিন ধরে দুজন বাসা খুঁজে বেড়াচ্ছি আর কোনটা কোন্ পাখির বাসা সেটা বুঝতে পারব না! দেখিস যদি গিয়ে ছানা না পাই তাহলে গাট্টা মেরে তোর মাথা ভেঙ্গে দেব কিন্তু‘! কপট রাগ দেখাল রাজু। তবে তাতেই থমকে দাঁড়াল সজল। সে বলল, এমন করলে আমি তোর সঙ্গে যাব না। এমনকি আর কোনোদিনও তোর সঙ্গে বাসা খুঁজতে বেরোব না। সজলের রাগ দেখে রাজু বলল, আমি তোকে এমনিতেই বলেছি। তুই আমার একমাত্র বন্ধু। আমি তোর সঙ্গে রাগ করতে পারি! রাজুর কথা শুনে হেসে ফেলল সজল। তারপর দুই বন্ধু আবার যুদ্ধজয়ের ভঙ্গিতে এগিয়ে চলল সামনের দিকে। ময়নাপাখি বিশাল এক কদম গাছের মাথায় বাসা বেঁধেছে। অত ওপরে গিয়ে দেখা সজলের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। তবে রাজুর কাছে ওখানে ওঠা কোনো ব্যাপারই নয়। কিন্তু‘ ও ভাবছে, অত ওপরে ওঠা যদি বিফলে যায়! গাছে ওঠার পর দেখা দেখা গেল, বাসাটা একদম খালি। তখন কী উপায় হবে! রাজু যখন এসব ভাবছে তখন ও দেখল, একটা পাখি বাসা ছেড়ে উড়ে গেল। বাসায় কিচিরমিচির করে উঠল ছানারা। সজল সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বলল, তোকে কি আমি ভুল বাসার খোঁজ দিতে পারি! দেখলি কেমন ছানারা চিৎকার জুড়ে দিয়েছে!

তাইতো দেখছি। রাজুও হেসে দিল। তরতর করে কাঠবিড়ালির মতো গাছ বেয়ে একেবারে মাথায় উঠে গেল রাজু। বাসাটা এখন ওর হাতের নাগালেই। বাসায় দুটো কুচকুচে কালো ছানা দেখা যাচ্ছে। কী দারুণ দেখতে! বাইরে শব্দ পেয়ে ছানা দুটো কিচকিচ করে ডেকে উঠে মুখ বাড়িয়ে দিল। হয়ত ভেবেছে ওর মা খাবার নিয়ে এসেছে। মনে মনে হেসে ফেলল রাজু। ছানা দুটো ভারি বোকা। প্রায় ওড়ার বয়সী হয়ে গেছে ওরা। আর দু-এক দিনের মধ্যেই উড়তে শিখে যাবে। তখন ওদের বাবা-মা এমনিতেই ওদের ছেড়ে দেবে। এখন নিয়ে গেলে কোনো সমস্যা নেই। নিজেরাই খেতে পারবে। রাজু আলতো করে ধরে ছানা দুটোকে ওর পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। পকেট থেকে মাথা বের করে ছানারা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রাজু ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, এখন তোমরা আমার বাড়িতে যাবে। তোমাদের কথা বলা শেখাব। কি, শিখবে তো? ছানা দুটো কী বুঝল তারাই জানে। তবে রাজুর প্রশ্নের জবাবে কিচকিচ করে ডেকে উঠল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close