সাদিয়া আফরোজ
প্রতীক্ষা
জিতুর ওপর আজ ভীষণ রাগ হচ্ছে তমার। বেশ কিছুক্ষণ ধরে ওর জন্য এই বটগাছের নিচটায় দাঁড়িয়ে আছে, তবু ওর আসার লক্ষণটুকু নেই। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। বরং জিতুরই আগে এসে এখানে থাকার কথা হয়েছিল। তবে আজ কেন দেরি হচ্ছে?
এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কোত্থেকে হুড়মুড় করে চলে এলো জিতু। শরীরে ক্লান্তির ছাপ, চেহারাজুড়ে উদ্বিগ্নতা। ভয়জড়ানো কণ্ঠে বলল, ‘তুমি এখনি চলে যাও এখান থেকে তমা, এখনি চলে যাও। ওরা এখনি আসবে, এ পথেই আসবে। জলদি করো।’ তমা ওর কথার কোনো মানেই বুঝতে পারল না। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘কী হয়েছে তোমার? এত অস্থির দেখাচ্ছে কেন? ওরা কারা?’
-এসব প্রশ্নের উত্তর পরে দেব। এখন চলো, নৌকা দিয়ে পথটুকু পার করে দিই আগে।
-আচ্ছা কিন্তু হয়েছে কী? সাংঘাতিক কিছু?
মারাত্মক সাংঘাতিক। পরে কথা হবে। ঠিকমতো যেও, কেমন? তুমি আসবে না? না, আমাকে এ পারে থাকতে হবে। আনিস, রফিক, ফাহাদ, সিফাত ভাই আমরা সবাই আছি। চিন্তা করো না। এই বলে তমার হাত টেনে ওকে নৌকায় তোলে জিতু। নৌকায় ওঠে না বসতেই হঠাৎ গুলির শব্দ।
‘আশপাশের কোথাও চলে এসেছে ওরা’ জিতুর রাগমিশ্রিত কণ্ঠ। আচমকা গুলির আওয়াজে তমা প্রায় বাকরুদ্ধ। ভয়ে জিতুর হাত শক্ত করে ধরে আছে। ভয় কিছুটা কমার পর জিজ্ঞাসা করল, ওরা কারা? গুলির শব্দ কোথা থেকে আসছে?
আমাদের গ্রামে মিলিটারি এসেছে তমা। ওরা এ দেশের কেউ না। পাকিস্তানি। গতকাল রাতে হঠাৎ এ গ্রামে হানা দিয়েছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাশের কয়েকটা ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। আমি আর রফিক কোনো মতে পালিয়ে রুমা আপাদের ঘরে চলে গিয়েছিলাম। সারাটা রাত যে কীভাবে কাটিয়েছি তা কেবল ওপরওয়ালাই জানেন। আমি জানতাম তুমি এখানে আসবে আজ। অপেক্ষা করবে আমার জন্য। তাই কোনো মতে পালিয়ে তোমাকে বাঁচাতে এসেছি। তোমরাও প্রস্তুত হও, তোমাদের গ্রামেও যেকোনো সময় চলে আসতে পারে এই নরপশুগুলো।
কথাগুলো বলতেই চোখ ভিজে ওঠে জিতুর। এই প্রথম জিতুর চোখে পানি দেখল তমা। ওর এখন কী বলা উচিত হবে হঠাৎই তা বুঝে উঠতে পারছে না। ওর হাতে থাকা রুমালটা দিয়ে জিতুর চোখের পানি মুছে দিল। সেই সঙ্গে এই বলে সান্ত¦না দিল, ‘আমার কিচ্ছু হবে না, চিন্তা করো না তুমি। কিন্তু তোমার কী হবে? কোথায় থাকবে তুমি?’
তমার কথা শেষ না হতেই জিতু বলল, ‘আমাকে নিয়ে ভেবো না তমা। তুমি ভালো থাকলে যেখানেই থাকি না কেন আমিও ভালোই থাকব। কিন্তু আমার যে ভয় হচ্ছে, তুমি আমাকে সাহসটা জুগিয়ে দেবে তো?’
-কী হয়েছে? খুলে বলো আমাকে?
‘আমি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে চাচ্ছি। কিন্তু এতে নাকি জীবনের ভয় আছে। তুমি ছাড়া একূলে আর কেউ নেই আমার। তাই সিদ্ধান্তটা যে তোমাকেই নিতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশ স্বাধীন করেই তোমার কাছে ফিরব আমি।’ ‘তুমি চাইলে এতে আর বাধা দেবো না আমি। তবে যেখানেই থাকো, নিজেকে সাবধানে রেখো কিন্তু...।’
স্বাধীনতার আজ সাতচল্লিশ বছর পরও জিতুকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এত বছর পেরিয়ে
গেলেও প্রায়ই ঘটনাটা মনে পড়ে তমার। হন্যে
হয়ে জিতুকে খুঁজতে থাকে তখন।
স্বাধীনতার এই নির্মম ঘটনা ওকে কাঁদায় প্রতিনিয়ত। জিতুর কথা ভেবে চোখের পানি
গড়িয়ে পড়ে অজান্তেই...।
"