reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১৬ অক্টোবর, ২০১৬

বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক

নতুন সম্ভাবনার হাতছানি

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

প্রাচীনকালেও চীন ছিল পূর্ব এশিয়ার অগ্রসরমান সভ্যতার প্রতীক। যার প্রভাব পড়েছিল জাপান, কোরিয়া, তিব্বত ও ভিয়েতনামের সভ্যতায়। সপ্তম থেকে চৌদ্দ শ শতাব্দী পর্যন্ত চীনকে বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রসরমান সভ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কাগজ, চীনামাটি, ছাপাখানা, বারুদ, রেশম ও দিকনির্ণয়ী কম্পাসসহ অনেক প্রযুক্তি চীনেই প্রথম উদ্ভাবিত হয়। চীনের কমিউনিস্ট সরকার ১৯৪৯ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর কৃষি ও শিল্প ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার অধীনে নিয়ে আসে। এরপর সত্তরের দশকের শেষ দিকে অর্থনীতির সংস্কার সাধনে হাত দেয় চীন। তারা বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। অর্থনৈতিক সংস্কার পরিকল্পনায় আরো নতুন ধারণা প্রয়োগ করে ১৯৮০ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত চীনা অর্থনীতি বছরে ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে একুশ শতকের শুরুতে চীন বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হয়।

বিশ্বের অর্থনৈতিক শক্তির পালাবদল ঘটতে চলেছে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল বছর তিনেক আগে প্যারিসভিত্তিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা। ২০১৪-এর অক্টোবরে আইএমএফের বরাত দিয়ে যুক্তরাজ্যের ডেইলি মেইল পত্রিকায় প্রকাশিত হয় চীন এখন বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক পরাশক্তি। এর মধ্য দিয়ে ১৪২ বছরের অর্থনৈতিক পরাশক্তির শীর্ষে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশকে পেছনে ফেলে দেয় চীন। এ অর্থনৈতিক পরাশক্তির দেশের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশ পৌঁছেছেন গত শুক্রবার। তাকে স্বাগত জানাতে উদগ্রীব ছিল বাংলাদেশ। একসময় মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী বাংলাদেশ ও মহাপ্রাচীরের দেশ চীনের সম্পর্ক এত দৃঢ় ছিল না। যে বাংলাদেশকে স্বাধীনতার পর স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠিত ছিল চীন, সেই দেশের ভাষায় পরে অনূদিত হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর পরের বইটিতে থাকবে শিল্পমন্ত্রী থাকাকালে বঙ্গবন্ধুর চীন সফরের কথা।

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আবহমান কালের। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত ধর্মগুরু অতীশ দীপঙ্কর ধর্ম প্রচারের জন্য চীন গিয়েছিলেন। ১৪০৫ সালে ইউনান প্রদেশে তৎকালীন স¤্রাট ইয়াং লে এই অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে প্রচেষ্টা শুরু করেন। এ সময়ে স¤্রাটের একজন প্রতিনিধি গৌড়ের স্বাধীন সুলতানের সময় এ অঞ্চল সফর করেন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর বঙ্গবন্ধু চীনের সঙ্গে প্রথম সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেন। এ সময় তিনি একজন কূটনীতিককে চীনে পাঠান। বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কের সূচনা হয় বঙ্গবন্ধুর সময়।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ‘সম্ভাবনার হাতছানি’ হিসেবে বিশ্লেষণ করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ সফরের মাধ্যমে দুদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক সম্পর্কের সূচনা হবে বলে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা। বাংলাদেশে ২৫টি বড় প্রকল্পে বিনিয়োগে নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রানুযায়ী, ২৭ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। ২৫ প্রকল্পকে সামনে রেখে ১৩ শ ৬০ কোটি ডলার চীনের কাছে সহায়তা হিসেবে চাওয়া হয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের এক নম্বর বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে কাজ করছে চীন। সি চিনপিংয়ের সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার বিনিয়োগের পরিধি বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। চীনের বিশাল জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রফতানির সুযোগ তৈরি হতে পারে; যা বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রগতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। তবে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের সঙ্গে প্রকল্প সহায়তা নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে। তাদের মতামত হচ্ছে, সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট বা সরবরাহ ঋণ চুক্তির ক্ষেত্রে অধিক পরিমাণ সহায়তা নেওয়া হলে তা পরে ঋণের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। কাজেই এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার কৌশলী ও সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করবে বলে জনগণ প্রত্যাশা করে। চীনের দিক থেকেও প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। গত ৩০ বছরের মধ্যে চীনের কোনো প্রেসিডেন্ট এবারই প্রথম বাংলাদেশ সফর করলেন। এ ক্ষেত্রে চীন বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ, উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের বিস্তৃতি ঘটাতে চায়।

এই সময়ে চীন ভূ-রাজনৈতিক কূটনীতির বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে চেষ্টা চালাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ সফরে যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হচ্ছে চীন এ অঞ্চলে যেমন অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রভাব বলয় বৃদ্ধি করতে চায়, তেমনি দক্ষিণ চীন সাগর তীরবর্তী বিশাল অঞ্চলের ওপর তাদের অধিকারের বিষয়ে বাংলাদেশের সমর্থন আদায় করতে চায়। এসব রাজনৈতিক বিষয়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেই বাংলাদেশকে চীনের সহায়তা নিতে হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশকে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি বিচার বিশ্লেষণ করে অগ্রসর হতে হবে। এ ব্যাপারে ভারতের নীতি অবস্থানের বিষয়টিও বাংলাদেশকে গুরুত্বসহকারে মনে রাখতে হবে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে নিবিড় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে, এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে চীনও বাংলাদেশকে যতটা সম্ভব নিজেদের আপন বলয়ে রাখতে চায়। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মনোভাব নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়ে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বাংলাদেশ চীনের সম্পর্ক দৃঢ়।

চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর বর্তমান সরকারের একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য। এ সাফল্য ঐতিহাসিক মাইলফলকে রূপ নেবে, যখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চীনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বলয় সম্প্রসারণ করতে সক্ষম হবে। সমুদ্রভিত্তিক অর্থনৈতিক বলয়ের ক্ষেত্রে সরকার চীনকে বিনিয়োগকারী হিসেবে সম্মত করতে সক্ষম হবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এ সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র প্রসারিত হবে। চীন বাংলাদেশে তৈরি পোশাকশিল্প, চামড়া ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে যাতে বিনিয়োগের সুযোগ গ্রহণ করতে পাওে, সে বিষয়ে সরকারকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। পোশাকশিল্পে চীন ও বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে। এটা কাটানোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার। বাংলাদেশের শ্রমমূল্য চীনের শ্রমমূল্যের চেয়ে কম হওয়ায় চীন যেন বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়, তার যৌক্তিকতা তুলে ধরতে হবে। শুল্কমুক্ত পণ্যের রফতানি বাড়ান ও তা সহজীকরণের বিষয়েও উদ্যোগী হতে হবে বাংলাদেশকে। এর ফলে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বর্তমানে যে বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে, তা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

তবে ঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কোনো বড় ছাড় যাতে দিতে না হয়, সে বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। চীনের প্রস্তাবিত বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের মাধ্যমে সম্পর্কের যে নতুন নতুন দিকগুলো সৃষ্টি হয়েছে, সে ক্ষেত্রে উভয়পক্ষকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, মহেশখালীর মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, বাংলাদেশের প্রস্তাবিত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল, শিল্প উৎপাদন প্রভৃতি ক্ষেত্রে চীনা বিনিয়োগের পরিমাণ যাতে বৃদ্ধি করা যায়, সে বিষয়ে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।

বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে আজ যে সম্পর্কের সূচনা হয়েছে, তার সফলতা যাতে বাংলাদেশ ঘরে তুলতে পাওে, সেদিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে। তবে তা কখনো আপসের মাধ্যমে নয়। যৌক্তিকতার মধ্য দিয়ে সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে তুলতে হবে।

লেখক : রেজিস্ট্রার ও বিভাগীয় প্রধান যন্ত্রকৌশল বিভাগ, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট), গাজীপুর

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist