রাজীবুল হাসান, শ্রীপুর (গাজীপুর)

  ২০ নভেম্বর, ২০১৭

অকুলের কুল অগতির গতি...

‘ও অকুলের কুল, ও অগতির গতি, ও অনাথের নাথ, ও পতিতের পতি...’-কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানটি যেন রচিত হয়েছে জন প্যাট্রিসিয়া অ্যান ভিভিয়ান কারের জন্য। যিনি গাজীপুরের শ্রীপুরে শিশুপল্লী প্লাস নামের একটি অনাথ আশ্রমে নিরলস কাজ করে চলেছেন মিডিয়ার আড়ালে, প্রচারণাকে তোয়াক্কা না করে। রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার উত্তরে গাজীপুরের শ্রীপুরে টেংরা গ্রামে ১৯৮৯ সালে ৬ ফেব্রুয়ারি প্যাট্রিসিয়া কার গড়ে তুলেছিলেন ‘শিশুপল্লী প্লাস’। ঘন সবুজে আচ্ছাদিত ৫১ বিঘা জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে প্রতিষ্ঠানটি। পুরো পল্লী ছায়াময় করে রেখেছে নানা জাতের গাছাগাছালি। ভেতরের রাস্তার দুই পাশে সারি সারি নারকেলগাছ। পাখির কলকাকলি আর শিশুদের হইচইয়ে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে ছায়া সুনিবিড় শিশুপল্লী প্লাস। শিশুদের হইহুল্লোড়, খুনসুটি, ও বাঁধভাঙা আনন্দ উপভোগ করেন ৬৬ বছর বয়সী ব্রিটিশ নাগরিক প্যাট্রিসিয়া কার। পেশায় ছিলেন বিমানবালা। শিশুপল্লী প্লাস এখন অনাথ শিশু, নির্যাতিত ও সুবিধাবঞ্চিত নারী এবং নদীভাঙনে নিঃস্ব শিশুদের ঠিকানা।

১৯৮০ সালের দিকে প্যাট্রিসিয়া একবার এক বন্ধুর সঙ্গে প্রথম বাংলাদেশে আসেন। ঢাকার ফার্মগেট এলাকার একটি অনাথ আশ্রমে এক শিশুকে তার মা নিয়ে আসেন। কলজের এই টুকরোকে আশ্রমে রেখে যখন মা চলে যাচ্ছিলেন তখন শিশুটি মায়ের আঁচল টেনে ধরছিল বারবার। শিশুটির বুকফাটা কান্নায় ছলছল করছিল আশ্রমের কর্তাদের চোখও। আর নাড়িছেঁড়া ধনকে আশ্রমে রেখে যাওয়ার এই দৃশ্য খুব কাছ থেকে দেখছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক প্যাট্রিসিয়া অ্যান ভিভিয়ান কার। এরপর প্যাট্রিসিয়া কার সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন বাংলাদেশের অনাথ শিশু আর অসহায় মায়েদের পাশে দাঁড়াবেন তিনি। মা ও শিশু যেন একসঙ্গে থাকতে পারে এমন একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে কাজ শুরু করেন। দুস্থ মা ও শিশুর জন্য একটি নিরাপদ আশ্রম গড়ার কাজে হাত দেন। ছেড়ে দেন বিমানবালার চাকরি। ১২০ জন অনাথ শিশু ও মাকে জোগাড় করে নিজেই প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ফ্যামেলিজ ফর চিলড্রেন’ নামে অন্য একটি আশ্রম। ঢাকার ইন্দিরা রোডের একটি ভাড়াবাড়িতে শুরু হয় প্যাট্রিসিয়া অ্যান ভিভিয়ান কারের স্বপ্নযাত্রা। পরে আশ্রমের নাম দেওয়া হয় ‘শিশুপল্লী প্লাস’।

প্যাট্রিসিয়া অ্যান ভিভিয়ান কারের সঙ্গে যুক্ত হন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের অন্য কর্মীরাও। ভাগ্যবিড়ম্বিত শিশু আর তাদের মায়েদের দেখতে যুক্তরাজ্য থেকে মাঝেমধ্যে ওই আশ্রমে আসতেনও অনেকে। বিষয়টা জানতে পারেন তখনকার ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের চেয়ারম্যান লর্ড কিং। তিনিও স্বাগত জানালেন। উদ্যোগটা যাতে একটা প্রকল্প হিসেবে দাঁড়াতে পারে, সেই ব্যবস্থাও করে দিলেন। এক সময় ব্রিটেনসহ সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে আলোচনায় আসে এই উদ্যোগ। ১৯৮৯ সালে পরিপূর্ণ দাতব্য সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে শিশুপল্লী প্লাস। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত প্যাট্রিসিয়া অ্যান ভিভিয়ান কার প্রায় সাড়ে তিন হাজার অনাথ শিশু ও মাকে পরম যতেœ লালন পালন করেছেন। শিশুদের পড়াশোনা করিয়েছেন। প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মক্ষম করে তুলেছেন। শিশুপল্লী প্লাসের সব শিশুই তাকে মা বলে ডাকে।

শিশুপল্লী প্লাসের পরিচালক মিয়ান মাইকেল জাহাঙ্গীর বললেন, বর্তমানে ১৩০ মা ও ৩০০ শিশু লালিত-পালিত হচ্ছে এখানে। তাদের সমস্ত দেখভালের দায়িত্ব এই প্রতিষ্ঠানটির। তাদের জন্য ভেতরে রয়েছে হাসপাতাল, মসজিদ, খেলার মাঠ ও স্কুল। সব শিশুর পড়াশোনা করা বাধ্যতামূলক। ইসলাম, বৌদ্ধ, হিন্দু ও খিস্টান ধর্মের সব উৎসব পালন করা হয় শিশুপল্লীতে। তিনি বলেন, একই দিন এখানকার সমস্ত শিশুর জন্মদিন পালন করা হয়। সেটা হলো ২৫ ডিসেম্বর। বড়দিন। সুশৃঙ্খল সব নিয়মে চলে এই আশ্রম। একই সময় খাওয়া, গোসল, ব্যায়াম কিংবা বিশ্রাম। মায়েদের জন্য রয়েছে সেলাই, কুটিরশিল্প, মমবাতি তৈরির প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। তারা তৈরি করেন হ্যান্ডমেড পেপার। এই হ্যান্ডমেড পেপার থেকে তৈরি শুভেচ্ছা কার্ডই চলে যায় যুক্তরাজ্যে। সেখানে দারুণ চাহিদা এই হাতে তৈরি কাগজের। জানা গেছে, ইংল্যান্ডের রানিও আছেন হ্যান্ডমেড পেপার থেকে তৈরি এসব শুভেচ্ছা কার্ডের ক্রেতাদের তালিকায়।

আগে প্রত্যেক অনাথকে আট-নয় বছর রাখা হতো। এখন রাখা হয় তিন-চার বছর। মায়েদের মাসিক এক হাজার ৮৫০ টাকাও করে দেয় শিশুপল্লী প্লাস। কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে এই টাকার একটা অংশ জমা রাখা হয় ব্যাংকে। আশ্রম ছেড়ে যাওয়ার সময় একসঙ্গে সেই টাকা তুলে দেওয়া হয় মায়েদের হাতে। গতকাল রোববার সকালে পল্লীতে গিয়ে কথা হয় রকেয়া (ছদ্মনাম) নামের তিন সন্তানের এক জননীর সঙ্গে। তিনি জানান, ‘তার স্বামী আরেক বিয়ে করছে। তিন সন্তান নিয়ে চলতে পারি না। তার মধ্যে ছোট ছেলে প্রতিবন্ধী। তাই এখানে চলে এসেছি।’ জামিনা নামের (ছদ্মনাম) এক নারী জানাল, এখানে এসে তার জীবনের মানে ফিরে পাওয়ার কথা।

প্যাট্রিসিয়া অ্যান ভিভিয়ান কার ১৯৫১ সালে যুক্তরাজ্যের করোয়াল গ্রামে জন্ম নেন। বাবা হ্যারল্ড কার ও মা রোজমেরি কার। এখন প্যাট্রিসিয়া কারের সময় কাটে শ্রীপুরের এমসি বাজার থেকে ৪ কিলোমিটার পূর্বদিকে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটী ইউনিয়নের টেংরা গ্রামের এই পল্লীতেই। প্যাট্রিসিয়া অ্যান ভিভিয়ান কার বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি সুন্দর দেশ। আমি বাংলাদেশকে ভালোবাসি। আমাকে এই দেশের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আমাদের খুবই সৌভাগ্য যে শ্রীপুরের মতো সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ জাযগাটি নিয়েছিলাম।’

‘আমরা সেই সব মা ও তাদের সন্তানদের সঙ্গে কাজ করি, যাদের পরিবার নেই, থাকলেও সহায়তা পান না। আমরা এমন মায়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুলি। যাতে তারা স্বাবলম্বী হয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে। মা ও শিশুদের দৈনন্দিন চাহিদার বেশির ভাগই উৎপাদিত হয় পল্লীর ভেতরে করা চাষাবাদ থেকে। রয়েছে পুকুর, সবজি বাগান, ফলমূল ইত্যাদি।’ আজীবন তিনি অনাথ মানুষের সেবা করে যাবেন বলে নিজের ইচ্ছার কথাই জানালেন প্যাট্রিসিয়া কার।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist