প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ১৩ আগস্ট, ২০২০

‘তিন মাস ধরি প্লাস্টিক সিন্যার তলত থাকি’

দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলে ভাঙনে সর্বস্বান্ত হওয়া মানুষের কষ্টের সীমা নেই। অন্যদিকে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের খামখেয়ালিপনায় তলিয়ে যাচ্ছে যশোরের শার্শার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্টÑ

কুড়িগ্রাম : ‘তিন মাস আগত (আগে) নদীত বাড়ি ভিটা সোউগ (সব) গেইছে। ঘরবাড়ি, জিনিসপত্র কিছুই আটকাবার পাই নাই। প্লাস্টিক আর সিন্যার (পাটখড়ি) তলত থাকি। চরত এলা অভাব, খাবার খুব কষ্ট। চেয়ারম্যান-মেম্বর কাইয়ো এখনা সাহায্য করবার আইসে নাই। ফির বোলে বান আইসপে, একটা ঘর না হইলে কেমন করি থাকি!’

বন্যা, ভাঙন আর খাদ্যকষ্টে সব হারানো ব্রহ্মপুত্র নদ বেষ্টিত দ্বীপচর চর গুঁজিমারিতে আশ্রয় নেওয়া নারী রহিমা বেগম নিজের কষ্ট আর গ্লানির কথা এভাবেই জানালেন।

রহিমার ঝুপড়ি ঘরটি জীর্ণ পলিথিন আর অর্ধপচা পাটখড়ির ছাউনি দেওয়া। একদিকে বাঁশের চাটাই আর একদিকে পলিথিনে ঘেরা। তবে বেশির ভাগ অংশই বেষ্টনীহীন, ফাঁকাÑ একপাশ থেকে অপর পাশের দুনিয়া দেখা যায়।

রহিমা জানান, ভাঙনে সব হারিয়ে চর বাগুয়া থেকে চর গুঁজিমারিতে এসে ঝুপড়ি ঘরে থাকছেন। স্বামী পোদ্দার আলী দীর্ঘদিন থেকে রোগাক্রান্ত ও শয্যাশায়ী। এক মেয়ের বিয়ে দিলেও যৌতুক দিতে না পারায় তাকে ফেরত পাঠিয়েছে জামাই পক্ষ। দুই ছেলে ও শ্বশুরবাড়ি ফেরত মেয়েকে নিয়ে ওই ঝুপড়িতেই বসবাস তাদের। বৃষ্টি এলে ঘরের বিছানাপত্র ভিজে একাকার হয়ে যায়।

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের চর বাগুয়ায় গত এক বছরে শতাধিক পরিবার গৃহহারা হলেও কারো ভাগ্যে পুনর্বাসনের সহায়তা মেলেনি। ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে আর দীর্ঘমেয়াদি বন্যায় মাসব্যাপী পানিবন্দি থাকছেন তিনি।

সম্প্রতি চর গুঁজিমারিসহ সাহেবের আলগা ও হাতিয়া ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, ব্রহ্মপুত্রের ভয়াল ভাঙনে একের পর এক বসতভিটা নদের গর্ভে চলে গেছে। কিছু ভিটার ক্ষতচিহ্ন এখনো দৃশ্যমান। বানের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়িতে কাদা আর আবর্জনা। কেউ কেউ বসতভিটা মেরামতে ব্যস্ত হলেও অনেক পরিবার ভিটে হারিয়ে অস্থায়ী ব্যবস্থায় বসবাস করছেন। নৌকা দেখলেই স্থনীয়রা এগিয়ে আসেন সাহায্যের প্রত্যাশায়।

চর গুঁজিমারির বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম জানান, ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে চরের শতাধিক পরিবার গৃহহারা হয়েছে। বিঘার পর বিঘা চিনা ও পাটখেত একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। অভাবের তাড়নায় মানুষ গরু, ছাগল ও মুরগি সস্তা দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। আমিনুল বলেন, ‘ভাঙনে ভিটেহারা মানুষ চরের পশ্চিম অংশে একটি গুচ্ছ গ্রামে অস্থায়ীভাবে চালা তুলে জীবনযাপন করছেন। কয়েকজন ছাত্র এসে কয়েকটি পরিবারকে সাহায্য করলেও চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কেউ সাহায্য নিয়ে আসেনি।’

সাহেবের আলগা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড ইউপি সদস্য গোলাম মোস্তফা জানান, তার নিজের বাড়িও ভাঙনে বিলীন হয়েছে। তিনটি মসজিদ ও দুটি বিদ্যালয়সহ তার ওয়ার্ডের শতাধিক পরিবার ব্রহ্মপুত্রে বিলীন হয়েছে। কিন্তু দুর্গতদের হাতে গোনা কয়েকটি পরিবারের জন্য খাদ্য সহায়তা ছাড়া পুনর্বাসনে আর কোনো বরাদ্দ পাওয়া যায়নি।

নদীভাঙন ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে গৃহীত উদ্যোগ প্রসঙ্গে উলিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল কাদেরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

বেনাপোল (যশোর) : যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের খামখেয়ালিপনায় ক্রটিপূর্ণ সøুইসগেট নির্মাণের কারণে ভারতের সীমান্তবর্তী ইছামতি নদীর জোয়ারের পানিতে যশোরের শার্শার দক্ষিণাঞ্চলের ৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হচ্ছে পানির নিচে। উত্তর শার্শায়ও ঢুকে পড়েছে ভারতের উজানের পানি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানালেন, যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ড ৮টি উপজেলার মধ্য ভবদহ নিয়ে ব্যস্ত। অথচ ইছামতির জোয়ারের পানি শার্শার রুদ্রপুর ও পুটখালীর খলশী খাল দিয়ে প্রবেশ করে শার্শা ও ঝিকরগাছার বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত করছে। উপজেলায় ৩টি সøুইসগেট থাকলেও তার কোনো খালাসি নেই, নেই নজরদারি।

শার্শা উপজেলার পুটখালী, গোগা, উলাশী, বাগআঁচড়া, কায়বাসহ ৫টি ইউনিয়নের প্রায় তিন হাজার হেক্টর জমির ফসল পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে। ইছামতির সঙ্গে সংযুক্ত রুদ্রপুর ও খলসী খালে ক্রটিপূর্ণ সøুইসগেট নির্মাণের ফলে ভারতের ইছামতি নদীর পানিতে এলাকা প্লাবিত হচ্ছে বলে চাষিদের অভিযোগ। ইছামতির পানি ঠেকাতে রুদ্রপুর খালে দুটি ও খলশী খালে একটি সøুইসগেট নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ থাকায় তা কোনো কাজে আসছে না। ফলে ওই খাল দুটি দিয়েই ভারতের পানি ঢুকে শার্শার বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত করছে।

কয়েকজন চাষি জানান, রুদ্রপুর, খলশী খালে পাম্পসহ স্বয়ংক্রীয় গেট নির্মাণ করলে এর স্থায়ী সমাধান হবে এবং চাষিরা বারো মাস ঘরে ফসল তুলতে পারবে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সৌতম কুমার শীল জানান, ৫টি ইউনিয়নে চলতি মৌসুমে ২০ হাজার ১৩১ হেক্টর জমিতে ফসল লাগানো হয়েছে। এতে ভারতের উজানের পানিতে ২ হাজার ৯৭০ হেক্টর জমির ধান পাট তরিতরকারিসহ সবজি ফসল তলিয়ে গেছে। এখানে ৪০০ হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। কাসবায় ৩৫০ হেক্টর, গোগায় ২২৫ হেক্টর, বাগআঁচড়ায় ২৫০ হেক্টর ও উলশীতে ১২৫ হেক্টর জমির ফসল ভারতের উজানের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

শার্শা উপজেলা নির্বাহী অফিসার পুলক কুমার ম-ল বলেন, এসি ল্যান্ড ও ইঞ্জিনিয়ারকে সঙ্গে নিয়ে বুধবার সকালে পুটখালী ও বারোপোতার বিভিন্ন অঞ্চল পরিদর্শন করেছি। ইছামতি নদীর পানির সমস্যাটা আন্তর্জাতিক ব্যাপার। পানি উন্নয়ন বোর্ড ইচ্ছা করলে এর সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে পারে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close