জিন্নাতুল ইসলাম জিন্না, লালমনিরহাট

  ২২ অক্টোবর, ২০১৯

কাজীর গরু খাতায়, গোয়ালে নেই

লালমনিরহাটে আদিতমারীতে প্রাইমারি বিদ্যালয়

লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার নামুড়ী বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ১৬ জন শিক্ষার্থীর পাঠদানের জন্য শিক্ষক আছেন চারজন। যাতায়াতের রাস্তা না থাকলেও বিদ্যালয়টি দ্বিতল ভবন করা হয়েছে। এ স্কুলে কাগজ-কলমে ১৩৭ শিক্ষার্থী থাকলেও বাস্তবে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৬ জন। কাজীর গরু হিসাবে আছে গোয়ালে নেই অবস্থা। এসব কথা জানা গেছে সরেজমিনে গিয়ে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে। তবে প্রধান শিক্ষক বীরেন্দ্র নাথ সরকার ওরফে শিয়ালু জানিয়েছে, তার বিদ্যালয় ঠিকঠাক চলছে। কোনো সমস্যা নেই।

সম্প্রতি বিদ্যালয়ে ক্লাস চলার সময় গিয়ে দেখা যায় বিদ্যালয়টির ৩য় শ্রেণিতে মাত্র চারজন, ৪র্থ শ্রেণিতে চারজন ও ৫ম শ্রেণিতে আটজন মিলে ১৬ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত। যাদের প্রত্যেকেই শ্রেণিকক্ষ ছেড়ে মাঠে খেলাধুলা করছিল। প্রধান শিক্ষক হাজিরায় স্বাক্ষর করে চলে যান বাহিরে। বাকি তিনজন শিক্ষকের একজন অফিস কক্ষে ঘুমালেও অন্য দুইজন বাহিরে অন্য কাজে ব্যস্ত। এই প্রতিবেদককে ছবি তুলতে দেখে শিক্ষকরা তাড়াহুড়া করে শিক্ষার্থীদের নিয়ে দৌড়ে ঢুকলেন শ্রেণিকক্ষে।

শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও স্থানীয়রা জানান, উপজেলার পলাশী ইউনিয়নের নামুড়ী গ্রামে ১৯৮৮ সালে নামুড়ী বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন স্থানীয় ব্যক্তিরা। প্রতিষ্ঠার সময় পড়াশোনার মান ভালো থাকায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বৃদ্ধিও পায়। পরে প্রধান শিক্ষক বীরেন্দ্র নাথ সরকার ওরফে শিয়ালুর একক আধিপত্যের কারণে দিনে দিনে নি¤œমুখি হয়ে পড়ে শিক্ষার মান, শিক্ষার্থীর সংখ্যা ও পরিবেশ। বাধ্য হয়ে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের পাশের বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। বিদ্যালয়ে যাওয়ার যোগাযোগব্যবস্থা না থাকলেও প্রধান শিক্ষক ক্ষমতা খাটিয়ে বিদ্যালয়টির রেজিস্ট্রেশন করেন এবং তার স্ত্রী সুজাতা রানীকে সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। ২০০২ সালে দ্বিতল ভবনের বরাদ্দ নিয়ে ভবন তৈরি করেন। এরপর ২০১৩ সালে সরকারি করা হয় এ বিদ্যালয়টি। জাতীয়করণের পরে প্রতিষ্ঠাকালীন তিন শিক্ষকের বদলি হলেও বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বীরেন্দ্রনাথ সস্ত্রীক রয়েছেন এ স্কুলেই। এ কারণে তিনি স্কুল চালাচ্ছেন তার ইচ্ছামাফিক।

বিদ্যালয় টিকিয়ে রাখতে পাশের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং ভুয়া নাম দিয়ে শিক্ষার্থীর হাজিরা খাতা তৈরি করেছেন এবং সে অনুযায়ী ভোগ করেন যাবতীয় সরকারি সুযোগ-সুবিধা। বাঁশ বাগানের ভেতর ও ধানখেতে আইলের রাস্তা দিয়ে বিদ্যালয়ের যোগাযোগ। নেই মূল ফটক। স্কুলে তথ্যের ডিসপ্লেবোর্ড থাকলেও সেখানে নেই বিদ্যালয়ের দরকারি তথ্য। প্রবেশ পথেই টয়লেটের খোলা ম্যানহোল। যেখানে মাঝে মধ্যেই ঘটছে দুর্ঘটনা।

৩য় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা জানায়, রুটিনে ক্লাস শুরুর ২ ঘণ্টা অতিবাহিত হলেও সংবাদকর্মীদের আগমনে শুরু হয় ক্লাস। তাদের চারজনকে নিয়েই ৩য় শ্রেণি। ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও জানালেন একই কথা। আসন্ন বার্ষিক পরীক্ষা সামনে হলেও এখন পর্যন্ত অনেক শিক্ষার্থীরা তাদের ক্লাস রোল বলতে পারেনি। রোল কল তেমন একটা হয় না বলেই তারা তাদের রোল জানে না বলে দাবি শিক্ষার্থীদের।

কয়েকজন অভিভাবক জানান, প্রধান শিক্ষক ও তার স্ত্রীর একক সিদ্ধান্তে চলে এ বিদ্যালয়। সবাই বদলি হলেও তাদের বদলি হয় না। এ বিদ্যালয়ে কতটুকু লেখাপড়া হয় এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছেন স্থানীয়রা।

প্রধান শিক্ষকের স্ত্রী বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা সহকারী শিক্ষক সুজাতা রানী বলেন, আগের তুলনায় পাঠদান ভালো হলেও রাস্তার অভাবে শিক্ষার্থীরা এই বিদ্যালয়ে আসতে চায় না। শিক্ষার্থীরা বিলম্বে আসায় ছুটির আগে হাজিরা নেয়া হয়। উপজেলা শিক্ষা অফিসের এক কর্মচারী বলেন, রাস্তা না থাকার পরও বিদ্যালয়টির যারা অনুমোদন দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।’

প্রধান শিক্ষক বীরেন্দ্র নাথ (শিয়ালু) বলেন, বিদ্যালয়ে হাজিরা দিয়ে বিদ্যালয়ের কাজে শিক্ষা অফিসে ছিলেন। পাঠদানের মানের জন্য নয়, রাস্তার অভাবে এখানে শিক্ষার্থী নেই বা আসতে চায় না। তবে এখানে ভুয়া শিক্ষার্থী নেই। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বদলি না করায় একই চেয়ারে কাটছে প্রায় ৩১ বছর।

আদিতমারী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার এন এম শরীফুল ইসলাম খন্দকার জানান, বিদ্যালয়টির এমন করুণ পরিস্থিতি তার জানা নেই। পরিদর্শন করে দরকারি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close