রেজওয়ান শরিফ, টাঙ্গাইল

  ২৩ জানুয়ারি, ২০১৯

প্রবাসীর স্ত্রীকে গলা কেটে হত্যা

খুনির বিচার চান প্রবাসী স্বামী ও ছেলে

ধলা খানের বয়স ৫০ ছুঁই ছুঁই। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে থাকেন প্রবাসে। প্রবাসে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজের এবং পরিবারের সুখের জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। অথচ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, দেশ ও পরিবারের প্রতি নিবেদিত ধলা খানের স্ত্রী মনোয়ারা বেগমকে (৩৮) ১ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার নথখোলা পৌলী গ্রামের নিজ বাড়ির ঘরের ভেতর গলা কেটে খুন করা হয়েছে। রোমহর্ষক এ ঘটনার ২০ দিন অতিবাহিত হলেও পুলিশ এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। নিহতের স্বামী ধলা খান শোকার্ত কণ্ঠে বলেন, প্রবাসে থেকে জীবনবাজি রেখে দেশ ও পরিবারের উন্নয়নের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছি। কিন্তু পরিবারের নিরাপত্তা দিতে পারলাম না। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় সন্দেহভাজনদের নাম গ্রামবাসীর মুখে মুখে আলোচিত হলেও পুলিশ এখনো কাউকে আটক করেনি। পুলিশের এ নীরব আচরণে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন এলাকাবাসী ও নিহতের স্বজনরা। সবার একটাই প্রশ্ন এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার কী কোনো সুষ্ঠু সুরাহা হবে না? তবে পুলিশের দাবি তদন্ত চলছে। খুব দ্রুতই ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন হবে।

সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, নথখোলা পৌলী গ্রামটিতে যাতায়াত করতে বেশ বেগ পেতে হয়। গ্রামে যেতে ভালো কোনো রাস্তাঘাট নেই বললেই চলে। গ্রামের ভেতর দিয়ে যাওয়া প্রায় সবক’টি রাস্তা কাঁচা ও ভাঙাচোরা। বর্ষাকালে চলাচলের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। গ্রামের একপ্রান্তে ধলা মিয়ার পৈতৃক বসতভিটা। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির তিনদিকে খোলা প্রান্তর ও আবাদি জমি। একদিকে জনবসতি। কয়েক বছর আগে ধলা মিয়ার অপর পাঁচ ভাই তাদের প্রাপ্ত বাড়ির অংশ বিক্রি করে গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বসতি গড়েন। আড়াই শতাংশ জমির ওপর একটিমাত্র টিনের ঘরে একাই থাকতেন ধলা মিয়ার স্ত্রী মনোয়ারা বেগম। একমাত্র ছেলে আল আমিন তিন বছর আগে বাবার মতো বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। স্বামী ও সন্তানকে ভিন দেশে পাঠিয়ে কোনো রকমে খেয়ে পড়ে সাদামাটা জীবনযাপন করতেন মনোয়ারা বেগম। মাঝে মাঝে বাবার বাড়ি ও দেবর-ভাসুরদের বাড়িতে যেতেন। তার পাশেই ছিল একমাত্র প্রতিবেশি আপন চাচা শ্বশুর শহর আলী খানের বাড়ি। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কনস্টেবল শহর খানের পরিবারের সঙ্গে ছিল তার সখ্যতা আবার নানা বিষয় নিয়ে বিরোধও। গ্রামে প্রবেশ করে বিভিন্ন জনের সঙ্গে আলাপ করে এমন আভাসই পাওয়া যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানান, মনোয়ারা বেগম প্রায়ই বলতো শহর খান তাকে সেখানে থাকতে দেবে না। আবার কেউ কেউ বলেন, মনোয়ারা বেগমের সাথে কারো কোনো বিরোধ ছিল বলে আমরা কখনো শুনিনি।

কালাম মাতাব্বর বলেন,পরিবারটির সাথে তাদের এক আত্মীয়ের টাকা নিয়ে বিরোধ ছিল। তিনি বলেন, শহর খান মসজিদ, মাদ্রাসায় জমি দান করেছেন। তিনি সামান্য কয়েক শতাংশ জমির জন্য এত বড় অন্যায় করবেন কেন?

গ্রামবাসীর একজন বলেন, বাড়িটির এক পাশে বসতি থাকলেও অন্য তিনদিকে খোলা ফসলের মাঠ। বাড়ির কোন নিরাপত্তা বেষ্টনীও নেই। মাঝে মাঝে চুরির ঘটনা ঘটতো। গাছ ও ঝোপঝাড়ে বাড়ির চারপাশে ভুতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে। এমন পরিবেশে বহিরাগত ও নেশাখোরদের আড্ডা থাকতে পারে।

মনোয়ারা বেগমের ভাসুর হেলাল খান বলেন, মনোয়ারার ঘরের সঙ্গে শহর খানের ঘরের দূরত্ব দুই হাত। রাতের বেলা জলজ্যান্ত একজন মানুষকে গলা কেটে হত্যা করা হলো। পুরো ঘরজুড়ে রক্ত ছিটানো। অথচ পাশের ঘর থেকে তারা কোন ধরনের আর্তচিৎকারের শব্দ পায়নি বিষয়টি খুবই অস্বাভাবিক।

হেলাল খানের ছেলে দেলু খান জানান, প্রায় দুই বছর আগে চাচি মনোয়ারাকে শহর খান ও তার ছেলে ঝগড়ার এক পর্যায়ে পানিতে ডুবিয়ে হত্যা চেষ্টা চালান। মাঝে মাঝেই তার বাড়িতে চুরির ঘটনা ঘটতো। তিনি একাধিকবার জিডি করেছেন বলেও জানান তারা।

মামলার বাদী নিহতের ভাইয়ের স্ত্রী তাসলিমা আক্তার বলেন, প্রতিবেশী একটি পরিবারের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধ ছিল। বিভিন্ন সময় হুমকি-ধামকি দিত। প্রকৃত অপরাধীদের ধরতে পুলিশ আশার বাণী শুনালেও তারা এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। তবে টাকা নিয়ে বিরোধের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।

নিহত মনোয়ারার প্রতিবেশী ও তার আপন চাচা শ্বশুর শহর আলী খান বলেন, আমার এক ভাইয়ের বউ ফজিলা বেগমকে দাওয়াত দিয়েছিলেন মনোয়ারা। সকালে ফজিলা বেগম তার বাড়িতে গিয়ে দেখে ঘরের দরজা খোলা। ভেতরে প্রবেশ করে বিছানার ওপর রক্তাক্ত গলাকাটা লাশ দেখতে পেয়ে চিৎকার করে ওঠেন। পরে আমরা সবাই দৌড়ে আসি। সব সময় মনোয়ার আমাদের বাড়িতে যেতেন এবং আমরাও তার বাড়িতে আসতাম। মতবিরোধ থাকলেও তাকে হত্যা করার মতো বিরোধ আমাদের মাঝে নেই।

স্থানীয় ইউপি সদস্য সিরাজুল ইসলাম লিটন বলেন, নিহত মনোয়ারার সঙ্গে কারো কোনো বিরোধ ছিল বলে আমার জানা নেই। তবে এমন নিরীহ একজন মানুষকে হত্যা করা হলেও খুনিরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকবে তা মেনে নেওয়া যায় না। পুলিশের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই তাজ উদ্দিন বলেন, মামলায় সুনির্দিষ্ট কাউকে আসামি করা হয়নি। তদন্ত চলছে; কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। মামলার তেমন কোনো অগ্রগতি না হলেও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলে যে কোনো ক্লু বের হয়ে আসতে পারে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোনো অগ্রগতির খবর না দিতে পারলেও বাসাইল থানার ওসি এসএম তুহিন আলী মামলার তদন্ত অগ্রগতি অনেক দূর এগিয়েছে দাবি করেন। তিনি বলেন, তদন্তের স্বার্থে এ মুহূর্তে কিছু বলা যাচ্ছে না। খুব শিগগিরই নৃশংস এ ঘটনায় কারা জড়িত তা জানা যাবে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। যাচাই-বাছাই হচ্ছে, প্রকৃত অপরাধীদের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই তাদের গ্রেপ্তার করবে পুলিশ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close