পাঠান সোহাগ

  ০১ অক্টোবর, ২০১৮

ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও চিকিৎসা অপ্রতুল

দেশে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা ২০ লাখের বেশি। প্রতি বছর নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে আরো দুই লাখ। আর বছরে মৃত্যু হচ্ছে দেড় লাখ মানুষের। বাংলাদেশে মৃত্যুর ষষ্ঠ প্রধান কারণও এই ক্যানসার। এই বিবেচনায় বিশ্বে ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। কিন্তু চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, জনবল ও শয্যাসংখ্যার ঘাটতি রয়েছে। তা ছাড়া অর্থনৈতিক সমস্যাও চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিশাল বাধা। পাশাপাশি পরিবেশের পরিবর্তন, ধূমপান, মদ্যপান, জাঙ্ক ফুড, আধুনিক জীবনযাত্রা সবকিছুর প্রভাবেই এ সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এসব কারণে রোগীদের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে।

বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির তথ্য মতে, প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার শনাক্ত হলে সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা শতভাগ হলেও প্রচার-প্রচারণার অভাবে জনসচেতনতা গড়ে উঠছে না। ফুসফুসের ক্যানসারজনিত মৃত্যুর ৯০ শতাংশই ঘটে ধূমপানের কারণে। শুধু ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য সেবন করা থেকে বিরত থাকলে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ ক্যানসার কমানো সম্ভব।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে স্তন, ফুসফুস, সারভাইক্যাল, হেডনেক, মূত্রথলি ও কলোরেক্টালÑএই ছয় ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার প্রমাণ মিলেছে। তবে পুরুষের ফুসফুস, পাকস্থলী এবং নারীর স্তন ও জরায়ু ক্যানসারে আক্রান্তের হার বেশি। কিন্তু চিকিৎসার সুযোগ অপ্রতুল।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদ- অনুযায়ী প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি ক্যানসার কেন্দ্র প্রয়োজন; সে হিসেবে বাংলাদেশে দরকার ১৭০টি। কিন্তু সরকারি পর্যায়ে ৯টি এবং বেসরকারি পাঁচটিসহ মোট ১৪টি কেন্দ্র রয়েছে। আর সারা দেশে ক্যানসার চিকিৎসার জন্য ৩০০ রেডিওথেরাপি মেশিনের জায়গায় আছে মাত্র ১৭টি। ক্যানসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন ১৫০ জন। নেই অনকোলজিস্ট ও বিশেষজ্ঞ নার্স। শয্যাসংখ্যা এক হাজার।

ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার (আইএআরসি) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, পুরো বিশ্বই দিনে দিনে অসহায়ভাবে হেরে যাচ্ছে ক্যানসারের কাছে। তারা বলছেন, বিশ্বে চলতি বছরে মারা যেতে পারে প্রায় এক কোটি মানুষ। ২০১৮ সালে বিশ্বজুড়ে ক্যানসার আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ। বছর ছয়েক আগের সেই সমীক্ষায় ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৪১ লাখ। তাদের মধ্যে প্রায় ৯ লাখ ৫৫ হাজার ২৭ জনের মৃত্যু ঘটে। প্রতি পাঁচজনের একজন পুরুষ ও প্রতি ছয়জনের একজন নারী বর্তমানে এই অসুখের শিকার। একুশ শতকে মানুষের মৃত্যুর প্রধান কারণই হয়ে দাঁড়াবে ক্যানসার। সম্প্রতি তাদের একটি সমীক্ষায় এমন তথ্যই উঠে এসেছে। একই কথা বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)।

ক্যানসার রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১২ হাজার নারী জরায়ুমুখের ক্যানসারে আক্রান্ত হয় এবং সাড়ে ছয় হাজারের বেশি মৃত্যুবরণ করে। এটি প্রতিরোধযোগ্য একটি ক্যানসার। সূচনায় ধরা পড়লে চিকিৎসায় পুরোপুরি সুস্থ হওয়া সম্ভব। প্রাথমিক অবস্থায় এ রোগের লক্ষণগুলো সবাইকে জানানো এবং লক্ষণ দেখা দেওয়ার আগেই নির্ণয়ের জন্য স্ক্রিনিং পরীক্ষার সাহায্য নেওয়া যায়। তিনি বলেন, দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন, নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও দ্রুত শনাক্তকরণের মাধ্যমে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত ও মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এ জন্য ব্যাপক জনসচেতনতা প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন।

আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অনকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. এহতেশামুল হক বলেন, ক্যানসারের বিষয়ে আমাদের নিজস্ব কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিশেষ কোনো প্রতিষ্ঠানের এ বিষয়ে পরিসংখ্যানও নেই। তবে আমরা বিভিন্ন সোর্স থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এ পরিসংখ্যান দিয়েছি। ক্যানসার সচেতনতা বৃদ্ধিতে ২০১৭ সালে আমরা দুই সপ্তাহের প্রোগ্রাম পরিচালনা করি। এ সময় আমরা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এক হাজার কর্মী এবং দি একমি ফার্মাসিউটিক্যালের কর্মীদের নিয়ে একটি স্ক্রিনিং প্রোগ্রামের আয়োজন করি।

ক্যানসার পরিস্থিতি উত্তরণের কয়েকটি উপায় ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেন, দেশে ক্যানসারের লক্ষণগুলো বিশেষ করে সাতটি সতর্ক সংকেত ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করতে হবে। ক্যানসারের প্রাথমিক প্রতিরোধের ওপর জোর দিতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডিন মতিউর রহমান মোল্লা বলেন, ২৫-৩০ শতাংশ হেডনেক ক্যানসার দেশে দেখা যায়। যাদের পুষ্টির অভাব আছে তারা যদি গুল, জর্দা, সুপারি অথবা মুখে এ জাতীয় খাবার খান তাদের ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তিনি বলেন, তিন বছর অন্তর অন্তর স্ক্রিনিং করা। ক্যানসার সচেতনতামূলক কাজ করা। পাশাপাশি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগকে এগিয়ে আসতে হবে। এই চিকিৎসা সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে।

আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক এ কে এম আমিনুল হক, বয়স্কদের ফুসফুসের ক্যানসারের ক্ষেত্রে সাধারণত অল্প অল্প জ্বর, কাশি অথবা কাশি দিলে কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় ব্যথা অনুভব করা, কণ্ঠের পরিবর্তন দেখা দিলে ক্যানসারের লক্ষণ প্রকাশ পায়। তখন আমরা সন্দেহ করি। এসব রোগীর ক্যানসার হওয়ার শঙ্কা বেশি।

এদিকে, গতকাল রোববার ক্যানসার বিষয়ে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে জতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত ‘ক্যানসার সচেতনতা মাস ২০১৮, মিডিয়া ওরিয়েন্টেশন’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অনকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. এহতেশামুল হক বলেন, ক্যানসার সচেতনতা বৃদ্ধিতে তার প্রতিষ্ঠান দুই সপ্তাহের প্রোগ্রাম পরিচালনা করে। তারা ঢাকা উত্তর সিটির এক হাজার কর্মী এবং দি একমি ফার্মাসিউটিক্যালের কর্মীদের নিয়ে একটি স্ক্রিনিং প্রোগ্রামের আয়োজন করেন। এর আগে ২০১৫ সালে নারায়গঞ্জে ছয় হাজার পোশাককর্মী এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০ শিক্ষার্থীকে স্ক্রিনিং করা হয়। পাশাপাশি সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এ বছর দুই সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি চলবে বলে জানান তিনি।

অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডিন মতিউর রহমান মোল্লা, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক এ কে এম আমিনুল হক, অধ্যাপক মীম নাসিম সোবহানি খন্দকার, সহযোগী অধ্যাপক মো. আতিকুর রহমান প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে ক্যানসার সচেতনতা মাস ২০১৮ উপলক্ষে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেরা সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচির তথ্য জানানো হয়। কর্মসূচির অংশ হিসেবে হাসপাতালটির বহির্বিভাগে আগামী ২ থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত স্তন, ফুসফুস, সারভাইক্যাল, হেডনেক, মূত্রথলি ও কলোরেক্টাল ক্যানসারের পরীক্ষা বিনামূলে করা হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close