কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি

  ২৮ জুলাই, ২০১৮

কিশোরগঞ্জে ঠাঁই নেই বন্দির কারাগার নির্মাণে অনিয়ম

কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগারে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। সেখানে বন্দি ধারণের ক্ষমতা ২৪৪ জনের। অথচ বন্দি রয়েছে ১ হাজার ৩৭৬ জন। ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত বন্দির সংকুলান না হওয়ায় চলতি মাসের ২১ তারিখ থেকে এ পর্যন্ত ২০১ জন বন্দিকে ময়মনসিংহ কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে।

অপরদিকে, কিশোরগঞ্জে নির্মাণাধীন নতুন কারাগারে নিম্নমানের কাজ হয়েছে মর্মে তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া কাজ ৩০ ভাগ বাকি রেখেই সমুদয় বিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ করা হয়েছে বলেও তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ কাজ অসমাপ্ত থাকায় কারাগারটি এখনো ব্যবহারের উপযোগীই হয়নি। শেষ হচ্ছে না বন্দিদের দুর্দশাকাল। জানা গেছে, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আলমগীর হুছাইনের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে এই মর্মে জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবরে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরীও কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন। সম্প্রতি কারা উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি-প্রিজন) মো. তৌহিদুল ইসলামও কিশোরগঞ্জে এসে নির্মাণাধীন কারাগার পরিদর্শন করে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেন বলে জানা গেছে।

কিশোরগঞ্জ শহরের কারাগারটি ব্রিটিশ আমলে নির্মিত। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী, শহরতলির খিলপাড়া এলাকায় কিশোরগঞ্জ-ভৈরব মহাসড়কের পাশে ২৮ একর জায়গার ওপর গণপূর্ত বিভাগের তত্ত্বাবধানে এক হাজার ৫০ জন কয়েদি ও হাজতির ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি নতুন কারাগার নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। জায়গা অধিগ্রহণ করা হয় ১৯৯৭ সালে আর প্যারিমিটার ওয়াল নির্মিত হয় ২০০২ সালে। এই কাজ ছাড়া বাকি স্থাপনা নির্মাণ, আসবাবপত্রসহ সামগ্রিক কাজের প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৮ কোটি ৩৮ লাখ ৩৬ হাজার টাকা।

দীর্ঘ দুই দশকেও নতুন কারাগারটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়নি। অথচ একই সঙ্গে শুরু হওয়া দেশের আরো কয়েকটি জেলার নতুন কারাগারের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়ে এখন কয়েদি ও হাজতি থাকতে শুরু করেছেন।

কিশোরগঞ্জের কারাগারটির বিভিন্ন কাজ কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পেয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আজমুল হক। গত ৩০ জুন নতুন নির্মিত কারাগারটি কারা কর্তৃপক্ষ বরাবরে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সামগ্রিক নির্মাণকাজ এখনো ৩০ ভাগ বাকি। ফলে এখনই কয়েদি ও হাজতিদের নতুন কারাগারে স্থানান্তর করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আলমগীর হুছাইনের নেতৃত্বে জেল সুপার মো. বজলুর রশিদ ও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ আল মাসউদসহ ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছিলেন। কমিটি গত ৬ জুলাই সরেজমিনে নতুন কারাগার পরিদর্শন করে। পরিদর্শনশেষে কমিটির পক্ষ থেকে ৩২টি সুনির্দিষ্ট ত্রুটি ও ঘাটতি উল্লেখ করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবরে গত ১০ জুলাই একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পার্শ্ববর্তী হাইওয়ে থেকে কারাগারের প্রধান ফটক পর্যন্ত হেঁটে বা গাড়িতে যাওয়ার মতো রাস্তা নির্মিত হয়নি। স্টাফ কোয়ার্টারে যাতায়াতের মতো কাঁচা-পাকা কোনো রাস্তাই নির্মিত হয়নি। প্যারিমিটার ওয়ালের ভেতর ও বাইরে কোনো ওয়াকওয়ে তৈরি হয়নি। কারাগারের ভেতর ও বাইরে মাটি ভরাটের কাজ ৫০ ভাগও সম্পন্ন হয়নি। রান্নাঘর ও বাথরুমের ভেন্টিলেটরের রডের সঙ্গে আত্মহত্যার সুযোগ রয়েছে, যা পরিবর্তন করা প্রয়োজন। অস্ত্রাগার প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই ছোট। ফাঁসির মঞ্চের কাজ শেষ হয়নি। প্রতিটি স্থাপনায় বাকলসহ নিম্নমানের কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে। আবাসিক স্থাপনার প্রতিটি সিঁড়িতে এসএস পাইপের পরিবর্তে লোহার মরিচা ধরা পুরনো পাইপ লাগানো হয়েছে। সীমানা প্রাচীর ভালোভাবে প্লাস্টার না করেই চুনকাম করা হয়েছে। তিনটি ওয়াচ টাওয়ারের মধ্যে একটির কাজ মাত্র শুরু হয়েছে, বাকিগুলো শুরুই হয়নি। কারাগারের ভেতর ও বাইরের কোনো অবকাঠামোর সঙ্গে পয়ঃনিষ্কাশন ড্রেনের পানির কোনো সংযোগ হয়নি। মাটি ভরাট না হওয়ায় সেফটি ট্যাংকের সঙ্গে কোনো লাইন সংযোগ হয়নি। মহিলা কারারক্ষী ব্যারাকের ফ্লোর টাইলস, বাথরুম, পানি, বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ এখনো সম্পন্ন হয়নি। অফিসের আসবাবপত্র, বাথরুম, পানি, বিদ্যুৎ, দরজা-জানালা ও ভেতর-বাইরের কাজ অসমাপ্ত রয়েছে। পুরুষ ব্যারাকে ফ্লোর টাইলস, বাথরুম, পানি, বিদ্যুৎ, দরজা-জানালা এবং রান্নাঘরে গ্যাস সংযোগ এখনো সম্পন্ন হয়নি। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোয়ার্টারের বাথরুম, পানি, বিদ্যুৎ সংযোগ এখনো হয়নি। মাস্টার ড্রেনের কাজ অসমাপ্ত রয়েছে। প্রতিবেদনে এরকম ৩২টি সুনির্দিষ্ট ত্রুটি ও ঘাটতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গণপূর্ত বিভাগ কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনায় গত মে মাসের প্রতিবেদনে ৯৫ ভাগ কাজ সম্পন্ন দেখানো হয়েছে। কাজের বিলও শতভাগ পরিশোধ করা হয়ে গেছে। বিল পরিশোধ করা সমীচীন হয়নি বলে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে। আর এমন সব কাজ বাকি রয়েছে, যা শেষ না হলে কারাগার সহসা ব্যবহার করার সুযোগ নেই বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। কমিটির চারটি পর্যবেক্ষণে জেলা গণপূর্ত বিভাগের দায়িত্ব পালনে অবহেলা, কাজ শেষ না হতেই বিল পরিশোধ বা অর্থ ছাড় করা, ঠিকাদারের স্বেচ্ছাচারিতা এবং মাটি ভরাটের মতো বিশাল কাজ একজন মাত্র ঠিকাদারকে দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

এসব পর্যবেক্ষণের প্রেক্ষিতে চারটি সুপারিশ পেশ করা হয়। এগুলো হলো, গণপূর্ত বিভাগের মনিটরিং জোরদার করার লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে কিশোরগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগে দক্ষ অফিসার পদায়ন করা, কাজ সমাপ্তির পূর্বেই বিল পরিশোধের বিষয়টি তদন্তপূর্বক দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ, ঠিকাপ্রাপ্ত যেসব ঠিকাদার যথাসময়ে কাজ করেননি তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া এবং প্রয়োজনে মাটি ভরাটের কাজ একাধিক ঠিকাদারকে দেওয়া।

কমিটির এই প্রতিবেদন, পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশমালার ভিত্তিতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়র মুর্শেদ চৌধুরী গত ১২ জুলাইয়ের স্বাক্ষরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি অগ্রগতি প্রতিবেদন পেশ করেছেন। প্রতিবেদনে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বাধীন কমিটির সুপারিশমালা বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে জেলা গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আজমুল হককে প্রশ্ন করলে জানান, কারাগারের নির্মাণ কাজ বাকি নেই। এখন রং করা এবং ধোয়া-মোছার কাজ চলছে। সেই কারণেই সমুদয় বিলও পরিশোধ করা হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist