মনির হোসেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে

  ১৩ জানুয়ারি, ২০১৮

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সেই রোমহর্ষক তাণ্ডব

ঝুলে আছে ১৬ মামলার তদন্ত ভুক্তভোগীরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক মাদ্রাসা ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে শহর জুড়ে মাদ্রাসা ছাত্রদের ব্যাপক তা-ব চালানোর ক্ষত এখনো শুকিয়ে যায়নি। দুই বছরেও এসব তা-বের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়নি। ভিডিও দেখে গ্রেফতার করা হয়নি হামলা ও অগ্নি সংযোগে জড়িত অভিযুক্তদের। তদন্তও আছে বাঁদর ঝোলা হয়ে। এ কারণে হতাশা প্রকাশ করেছেন স্থানীয় ভুক্তভোগী সাংস্কৃতিক কর্মীরা। তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। তবে পুলিশ বলেছে মামলাগুলো খুব স্পর্শকাতর তাই চার্জশিট দিতে সময় লাগছে।

সেদিন গত ২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি রণক্ষেত্রে পরিণত হয় পুরো শহর। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ আর লুটপাটের ঘটনায় অন্তত এক শ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। তা-বলীলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন, উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আলউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন ও শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরের কয়েটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয়। এসব ঘটনায় দায়েরকৃত ১৬ মামলায় নাম উল্লেখ করে ১৬২ জন ও অজ্ঞাত সাত হাজার ১৫০ জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে কেবল ৩২৯ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে বেশিরভাগই এখন জামিনে মুক্ত। যদিও উল্লেখযোগ্য কাউকেই গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। তাছাড়া দুই বছর পেরিয়ে গেলেও ১৬ মামলার তদন্ত কাজে কোনো অগ্রগতি নেই। তবে পুলিশ বলেছে, অচিরেই আদালতে সবগুলো মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।

ঘটনা-১

২০১৬ সালের ১১ জানুয়ারি বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরশহরের জেলা পরিষদ মার্কেটের সামনে অটোরিকশার ভাড়া নিয়ে অটোচালকের সঙ্গে স্থানীয় জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার এক ছাত্রের কথাকাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে জেলা পরিষদ মার্কেটের বিজয় টেলিকমের স্বত্বাধিকারী জয় ওই মাদ্রাসা ছাত্রকে এসে থাপ্পড় দেন। এ নিয়ে সন্ধ্যায় অর্ধশত ছাত্র বিজয় টেলিকমে গিয়ে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। পরে পুলিশ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে মাদ্রাসা ছাত্রদের শান্ত করতে চাইলে উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া হয়। এক পর্যায়ে তা রূপ নেয় সংঘর্ষে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাও মাদ্রাসা ছাত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ত্রিমুখী এ সংঘর্ষ চলাকালে শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে ২০-২৫টি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কয়েক রাউন্ড রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে। কয়েক দফা চলা ওই সংঘর্ষে তিন পুলিশসহ অন্তত ২০ জন আহত হন।

ঘটনা-২

মাদ্রাসা ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ত্রিমুখী সংঘর্ষের ঘটনায় ১২ জানুয়ারি ভোরে জেলা সদর হাসপাতালে হাফেজ মাসুদুর রহমান (১৮) নামের আহত এক মাদ্রাসা ছাত্রের মৃত্যু হয়। মাসুদের সহপাঠীরা অভিযোগ করেন, সংঘর্ষের সময় পুলিশের হামলায় মাসুদের মৃত্যু হয়। মূলত মাসুদের মত্যুর পরই বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর। এদিন সকাল থেকে বিক্ষুব্ধরা শহরের হাসপাতাল রোড, লোকনাথ ময়দান এবং টিএ রোডে টায়ার জ্বালিয়ে ও বাঁশ ফেলে সড়ক অবরোধ করে। এরপর মাদ্রাসা ছাত্রদের একটি বিক্ষোভ মিছিল থেকে স্থানীয় ব্যাংক এশিয়ার শাখার গ্লাস ভাঙচুর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর-৩ আসনের সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর ছবি সম্বলিত বেশ কিছু ব্যানার ছিঁড়ে ফেলা হয়।

ঘটনা-৩

মাদ্রাসা ছাত্র মাসুদের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১২ জানুয়রি সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনে দুদফা হামলা চালিয়ে ভাঙচুর এবং রেললাইনে অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ মাদ্রাসা ছাত্ররা। তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার এস এম মহিদুর রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে একদল মাদ্রাসা ছাত্র অতর্কিতভাবে রেলওয়ে স্টেশনে এসে হামলা চালায়। এ সময় তারা স্টেশনের এক নম্বর প্লাটফরমের দরজা-জানালা, স্টেশন মাস্টারের কক্ষ, প্যানেল বোর্ড, টেলিফোন ও চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করে। এছাড়া বিক্ষুব্ধরা স্টেশন সংলগ্ন রেলক্রসিংয়ে গাছের গুঁড়ি ফেলে ও টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ করে রাখে। এতে করে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

ঘটনা-৪

১২ জানুয়ারি দুপুরে শহরের হালদারপাড়াস্থ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়েও হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেন বিক্ষুব্ধ মাদ্রাসা ছাত্ররা। এ সময় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের পাশের একটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন বিক্ষুব্ধরা। এরপর হামলাকারীরা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গনে হামলা চালিয়ে চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করেন এবং সংগীতাঙ্গনের জাদুঘরে সংরক্ষিত ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র সরোদ ও জায়নামাজসহ অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র ভেঙে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। একই সময়ে শহরের ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত ভাষা চত্বরের বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয়েও হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে বিক্ষুব্ধরা।

ঘটনা-৫

১২ জানুয়ারি বিকেলে কে বা কারা গুজব ছড়িয়ে দেয় যে, হাসপাতাল থেকে নিহত মাদ্রাসা ছাত্রের মরদেহ দেওয়া হচ্ছে না। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ মাদ্রাসা ছাত্ররা শহরের টিএ রোডস্থ ফকিরাপুলে দাঁড়ানো অবস্থায় পুলিশ সদস্যদের বহনকারী একটি পিকআপ ভ্যানে আগুন ধরিয়ে দেয়। একই সময়ে জেলা সদর হাসপাতালে ভাঙচুর চালায় বিক্ষুব্ধরা। তা-বের পরও হাফেজ মাসুদুর রহমানের মৃত্যুর প্রতিবাদে ও সদর মডেল থানার তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) তাপস রঞ্জন ঘোষ ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আকুল চন্দ্র বিশ্বাসের প্রত্যাহারের দাবিতে হরতাল ডাকে কওমি ইসলামী ছাত্র ঐক্য পরিষদ। বিক্ষুব্ধ মাদ্রাসা ছাত্রদের নিবৃত করতে ১২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসায় বৈঠকে বসে জেলা প্রশাসন। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে চলা ওই বৈঠক শেষে এসএসপি তাপস রঞ্জন ঘোষ এবং ওসি আকুল চন্দ্র বিশ্বাসকে প্রত্যাহার এবং নিহত ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের আশ্বাস পেয়ে হরতাল প্রত্যাহার করে নেয় বিক্ষুব্ধরা। এর ফলে থমথমে থেকে স্বাভাবিক হতে শুরু করে শহরের পরিস্থিতি।

এদিকে, মাদ্রাসা ছাত্রদের চালানো তা-বের ঘটনার দুই বছরেও পুলিশ প্রকৃত হামলাকারীদের গ্রেফতার করতে পারেনি বলে অভিযোগ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। এ নিয়ে সংস্কৃতি কর্মীদের মধ্যেও ক্ষোভ বিরাজ করছে। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ মামলার বাদী আবদুল মান্নান সরকার বলেন, মৌলবাদীরা হামলা চালিয়ে যে সংগীতাঙ্গনের যে ক্ষতি করেছে সেটি থেকে উত্তোরণ হওয়া গেলেও সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ব্যবহৃত যে জিনিসপত্রগুলো ধ্বংস করা হয়েছে সেটি তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তবে দুই বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত বিচার না হওয়ায় আমরা ক্ষুব্ধ। দ্রুত এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক আবদুন নূর বলেন, কোনো রহস্যজনক কারণে তা-বের ঘটনার মূল নায়কদের গ্রেফতার করেনি পুলিশ। এ কারণে আবারও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আক্রান্ত হবে না,এ নিশ্চয়তা কে দেবে? সংস্কৃতিকর্মীরা এ নিয়ে ভীষণ মনোকষ্টে আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস আবৃত্তি সংগঠনের সহকারী পরিচালক বাছির দুলাল বলেন, দুই বছর পেরিয়ে গেছে অথচ পুলিশ প্রকৃত আসামিদের গ্রেফতার করতে পারছে না। তা-বের পর শুধু সংসদ সদস্য মোকতাদির চৌধুরী ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে আর্থিক সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার সহায়তা করা হয়নি, হামলাকারীদের বিরুদ্ধে সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে এ তা-বের সুষ্ঠু বিচার নিয়ে আমরা শঙ্কিত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নবীর হোসেন এ ব্যাপারে বলেন, সবগুলো মামলা স্পর্শকাতর হওয়ার কারণেই আমাদের তদন্ত কাজে বেশি সময় লাগছে। তবে অচিরেই মামলাগুলোর অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist