প্রতীক ইজাজ

  ১১ ডিসেম্বর, ২০১৭

আলোচনার টেবিলেই সংকটের সমাধান

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র এক বছর বাকি। নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে এরই মধ্যে নানা প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। জাতীয় রাজনীতিতে বইছে নির্বাচনী হাওয়া। তেমনি নির্বাচন ঘিরে মানুষের মধ্যেও এক ধরনের আমেজ লক্ষ করা যাচ্ছে। অথচ দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা নির্বাচন ঘিরে যে বিতর্ক ও সংকট, সেটার সমাধানে এখন পর্যন্ত কোনো আভাস মিলছে না। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে থাকা প্রধান দুই দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির কাউকেই সমঝোতার উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না।

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপিকে ভোটে আনতে দলটির নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে কোনো ধরনের সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দেওয়ায় নির্বাচনী সংকট নিয়ে রাজনীতিতে আবার শুরু হয়েছে নতুন আলোচনা। এমনকি ‘এবার আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে না। বিএনপি নাকে খত দিয়ে নির্বাচনে আসবে। এবার আর তারা ভুল করবে না’—সেদিন প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে আশাবাদ প্রকাশ পেলেও সংকট সমাধানের ব্যাপারে কোনো আভাস মেলেনি। উল্টো সরকারের দুই মন্ত্রী নির্বাচন নিয়ে দেখা দেওয়া সংকট সমাধানের সম্ভাবনা এক ধরনের নাকচ করে দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের দুই দিনের মাথায় গত শনিবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘বিএনপিকে সংবিধান মেনেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে হবে এবং দলটিকে নির্বাচনে আনতে সংবিধান সংশোধন আনার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।’ একই দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও বলেছেন, ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী যথানিয়মে, যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হবে। কোন সরকার এল গেল, তার বিবেচনা না করে নির্বাচন কমিশন তাদের নিজস্ব গতিতে নির্বাচন পরিচালনা করবে। এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনী তাদেরকে সার্বিক সহযোগিতা করবে।’

অথচ বিএনপির দাবি অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে নির্বাচনের জন্য আইন সংশোধন করতে হবে। এমনকি নির্বাচনে ম্যাজেস্ট্রেসি পাওয়ারসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন, সংসদীয় আসন সীমানা ও ইভিএম নিয়ে যে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা, সেটার সমাধানেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনায় বসতে হবে। এমনকি নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি (সবার জন্য সমান সুযোগ) ও সব দলকে নির্বাচনে আনতে নির্বাচন কমিশন নাকি সরকার—কে উদ্যোগ নেবে, সে ব্যাপারেও রাজনৈতিক দলগুলোকেই সমাধান বের করতে হবে। এর জন্য আলোচনায় বসতে হবে।

এমন পরিস্থিতিতে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন কি সংবিধান অনুযায়ীই হবে, নাকি আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার পথে হবে—এ নিয়ে সংকট থেকেই যাচ্ছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি কি আবারও নির্বাচন বয়কটের পথে হাঁটবে, নাকি মুখে নানা কথা বললেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেবে এবং কোন প্রক্রিয়ায় এর সহজ সমাধান—এখনো কিছুই বলতে পারছেন না কেউ। আবার বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচনের উদ্যোগ নেবে ক্ষমতাসীনরা, নাকি বিদ্যমান সংবিধানে বাতলে দেওয়া পথেই থাকবে—এটিরও চূড়ান্ত উত্তর জানা নেই কারোই। এমনতর প্রশ্নের উত্তর অজানা থাকায় নির্বাচন নিয়ে নানা শঙ্কা ডালপালা মেলছে। নির্বাচনী রাজনীতিতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়টি দুলছে আশা-নিরাশার দোলাচলে। পরিস্থিতি এভাবে এগোতে থাকলে শঙ্কা দেখা দিচ্ছে রাজনৈতিক সংঘাতেরও। কারণ নির্বাচন নিয়ে নিজ নিজ অবস্থানে এখন পর্যন্ত অনড় রয়েছে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ।

কারণ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পাল্টা জবাবে সেদিনই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে নাকে খত দিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে আগামী নির্বাচন আয়োজনে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের বাধ্য করা হবে।’ এমনকি নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকেই উদ্যোগ নিতে হবে বলেও মন্তব্য করেছেন বিএনপির এই নেতা। তিনি প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেছেন, ‘এটা তার দায়। নির্বাচনের একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা, সব দলকে নিয়ে আসার দায় তার, যিনি সরকারপ্রধান। কারণ নির্বাচন করবেন কী করবেন না, নির্বাচন হবে কী হবে না—এটার দায়দায়িত্ব তাকেই বহন করতে হবে।’ একই সঙ্গে গতকালও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা আগেও বলেছি, এখনো বলছি, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। তাই একটি সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই।’

সংকট সমাধানে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের আলোচনার টেবিলে বসতে হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলেন, আলোচনার টেবিলেই দরকষাকষি হবে। চূড়ান্ত হবে ফর্মুলা। এসবের মধ্য দিয়ে সবার অংশগ্রহণে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ বের হয়ে আসবে বলে তারা বিশ্বাস করেন। সংঘাতময় পরিস্থিতিতে না গিয়ে সংলাপের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করতে হবে।

বিশ্লেষকরা এমনও বলেন, দেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপের বিকল্প নেই। নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে দুই দল নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকলে দেশে আবারও সংঘাত, সংঘর্ষের রাজনীতি শুরুর আশঙ্কা আছে। এটি দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। তাই খোলা মন নিয়ে তাদের সংলাপে বসে সমস্যার সমাধান করতে হবে। আগামী সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে তারা আশাবাদী। তারা মনে করেন, দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের কিছু না কিছু ছাড়ের মাধ্যমেই সংলাপ ফলপ্রসূ হবে।

তবে এখনই নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রকার শঙ্কা প্রকাশ ঠিক হবে না বলে মনে করছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, নির্বাচনী রাজনীতির ভবিষ্যৎ বাণী করা কঠিন। এখনো নির্বাচনের এক বছর বাকি। কী হবে, কী হবে না—এত আগে থেকে চূড়ান্ত করে বলা সম্ভব নয়। কারণ এখন যে পরিবেশ-পরিস্থিতি, শেষ দিকে সেরকম না-ও থাকতে পারে। তাছাড়া নির্বাচন কমিশনে দলীয় নিবন্ধন টিকিয়ে রাখতে হলেও বিএনপিকে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। সেজন্য আশা রাখছি, সার্বিক দিক ও ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা বিবেচনায় নিয়ে সব পক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ ধরবে।

অন্যান্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বলছেন, এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। কারণ এখন পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি স্পষ্ট করে কিছু বলছে না। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের যৌথসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘আলোচনার মাধ্যমে’ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ তৈরি, নির্বাচনে বিএনপি আসবে ও আগামী নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে—এমন বক্তব্যে যেমন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে আশা জেগেছে; তেমনি আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী নির্বাচন হবে, সেখানে সরকার নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা দিয়ে যাবে। অন্যদিকে বিএনপি নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা দাবির আংশিক নাকি সম্পূর্ণ পূরণ হলে নির্বাচনে অংশ নেবে; নাকি কোনো অবস্থাতেই একাদশে আর ওয়াকওভার দেবে না—এর কোনোটিই এখনো সুনির্দিষ্ট করেনি। বরং নির্বাচন সামনে রেখে সব ধরনের বক্তব্যই রেখে যাচ্ছেন বিএনপি নেতারা। এসব বক্তব্যের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে আগামীতেও নির্বাচনে না যাওয়া, বিএনপিকে বাইরে রেখে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন হতে না দেওয়া—উভয় ধরনের বার্তাই রয়েছে।

দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের এমন বৈরী অবস্থানের মধ্যেও আশা দেখছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন, নিরপেক্ষ, নির্দলীয় বা সহায়ক—যে ধরনের সরকারের কথাই বলুক না কেন; আমার মতে, বিএনপির এই দাবির এখন আর তেমন কোনো ভিত্তি নেই। আগামী নির্বাচনও শেষ পর্যন্ত এই সরকারের অধীনেই হবে।

সংবিধানে এসব ইস্যুর ব্যাপারে সুস্পষ্ট বিধান থাকায় এবং এখন পর্যন্ত সরকারের সদিচ্ছা অব্যাহত থাকায় শেষ পর্যন্ত এসব ইস্যু কোনো সংকট তৈরি করবে না বলে মত দিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম থেকেই বলে আসছেন এবার নির্বাচন হবে সব দলের অংশগ্রহণে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। তবে এসব ইস্যুতে যে আলোচনার কথা বলা হচ্ছে, সেটি যে কেবল আনুষ্ঠানিকভাবেই হতে হবে, এমনটা ঠিক নয়। সংলাপ বা আলোচনা হতে পারে পর্দার আড়ালে, দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে, শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যেও।

এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে, নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, সংসদ ভেঙে দেওয়া হবে কি না—সবকিছুই সংবিধানের ১১৮-১২৬ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা আছে। এক কথায় বলতে গেলে, নির্বাচন করবে ইসি, তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে সরকার। সহযোগিতার বিষয়টি সরকারের দায়িত্ব নয়, সাংবিধানিক কর্তব্য। নির্বাচনের সময় সরকার ছোট হবে, ইসি বড় হবে। আর এসব যদি আলোচনা করে ঠিক করতে পারি, তাহলে সংকট হবে না। এজন্য আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সংশ্লিষ্ট সবারই উচিত ইসিকে সহযোগিতা করা।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জাতীয় সংসদ নির্বাচন,রাজনীতি,আওয়ামী লীগ,বিএনপি,ইসি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist