বদরুল আলম মজুমদার

  ২১ ডিসেম্বর, ২০১৮

ঐক্যফ্রন্টের লক্ষ্য শেষ ৫ দিন

নির্বাচনী মাঠে এখনও ঐক্যফ্রন্টের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো নয়। জোটের নেতারা অভিযোগ করেছেন, প্রতিপক্ষের হামলা-মামলার কারণে দেশের কোথাও তারা নির্বাচনী প্রচার চালাতে পারছেন না। কিছু জায়গায় ধানের শীষের প্রার্থীরা হামলার শিকারও হয়েছেন। জোটের নেতাদের অভিযোগ, শুধু তফসিলের পরই আটক হয়েছেন দুই হাজারের বেশি নেতাকর্মী। তবে সরকারের দায়িত্বশীল মহল এর পাল্টা জবাবে বলেছে, যাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, কেবল তাদেরই গ্রেফতার করা হয়েছে। ভোটের বাকি আর মাত্র ৯ দিন, এখনো ঢাকাসহ অনেক নির্বাচনী আসনে মাঠে প্রার্থীর উপস্থিতি দেখা যায়নি। এমন প্রতিকূল অবস্থা মেনে নিয়েও বিএনপি ও ফ্রন্টের নেতারা নির্বাচন থেকে কোনো মতেই সরে যাবেন না বলে জানিয়েছেন।

জোটের নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, তারা আগামী ২৪ তারিখ পর্যন্ত কৌশলেই প্রচার কাজে থাকবেন। লক্ষ্য ভোটের শেষ ৫ দিনে মাঠ নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়া। আগামী ২৪ তারিখ নির্বাচনী মাঠে সেনাসদস্যেদের নামার কথা রয়েছে। ভোটের মাঠে পুলিশ প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি করলেও দলগুলোর মনে করছে সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে তেমন পরিবেশ আর থাকবে না। তাছাড়া ধরপাকড় বন্ধ হলে নির্বাচনী মাঠের প্রভাব ঐক্যফ্রন্টের অনুকূলে আসবে। তাছাড়া ঐক্যফন্টের একাধিক শীর্ষ নেতা শুধু ভোটের দিনকে টার্গেট করে বক্তব্য রাখছেন। ভোটের মূল প্রচারণার ২০-২২ দিন মাঠে না থেকে শুধু ভোটের দিনকে কেন টার্গেট করা হচ্ছে—এমন প্রশ্নে উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, দলীয় সরকারের অধীনে একদিনের সুযোগকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে ভোটের বিপ্লব হতে পারে।

কারণ হিসেবে তারা বলছেন, মানুষ এ সরকারকে আর চায় না। ভোটাররা কেন্দ্রে যেতে পারলে জনরায়ের বিপ্লব ঘটবে। এমন আত্মবিশ্বাস নেতাদের মনে জন্মেছে। তাই বিএনপির মহাসিচব মির্জা ফখরুল, ড. কামালসহ জোটের সিনিয়র নেতারা যেকোনোভাবেই মাঠে থাকার ওপর জোর দিয়েছেন। অব্যাহত ধরপাকড় কমে গেলে সাধারণ মানুষ ভোট কেন্দ্রে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে ভয় ছড়ানোর অভিযোগ করছেন অহরহ। তারা মনে করছেন, সরকারও জানে মানুষ ভোট দিতে পারলে ফল তাদের বিপক্ষে যাবে তাই নির্বাচন থেকে বিএনপিকে সরানো বা মানুষকে ভোট কেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত করতেই ভোটের মাঠে পরিকল্পিতভাবে ভয় ছড়ানো হচ্ছে। সরকারের এমন কৌশলের বিপরীতে ঐক্যফ্রন্ট নেতারাও শক্ত কৌশল নিয়ে সামনে হাঁটছেন।

শেষ দিনের চূড়ান্ত কৌশলের অংশ হিসেবে জোটের শীর্ষ নেতারা প্রার্থীদের প্রচারে কৌশলী হতে নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রতীক নিয়ে মাঠে নামার পর থেকেই প্রচন্ড বাধা-বিপত্তির মুখে পড়ছেন বিএনপি জোটের প্রার্থীরা। এরই মধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গণসংযোগকালে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও পুলিশের হামলা-নির্যাতন এবং গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে। এতে বেশ নিরাপত্তাহীনতা ও আতঙ্ক বিরাজ করছে সংশ্লিষ্টদের মাঝে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যেকোনো মূল্যে নির্বাচন পর্যন্ত মাঠে টিকে থাকতে চান প্রার্থীরা। এজন্য আপাতত সংঘাত এড়িয়ে সতর্কতার সঙ্গে প্রচারণা চালিয়ে শেষ ৫ দিনে শক্তভাবে ভোটের মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিতে চান তারা। তাছাড়া ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে ধানের শীষের এজেন্ট ও ভোটারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা, ফল গণনা পর্যন্ত ভোটকেন্দ্র পাহারা দেওয়ার জন্য কমিটি গঠনসহ প্রাথমিক কাজগুলো সেরে রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

দলীয় সূত্র মতে, নানা বাধা-বিপত্তি ও চরম প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও খালেদা জিয়ার মুক্তি, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও দেশের বর্তমান অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আন্দোলনের অংশ হিসেবে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি জোট। ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে ২৯৮ আসনে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী দিয়ে ভোটযুদ্ধে নেমেছে বিএনপি। যদিও এর মাঝে আটটি আসনে বিএনপির জোটের প্রার্থী শূন্য হয়ে পড়েছে। এদিকে নির্বাচনে আদালতের রায়ে যে আট আসনে বিএনপির প্রার্থী বাদ পড়ে গেছেন সেসব আসনে পুনঃতফসিল ঘোষণার দাবি জানিয়েছে দলটি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান নির্বাচন কমিশনে সাক্ষাৎ শেষে গতকাল বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, ‘আমরা জানি যে নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। এক্ষেত্রে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে যাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের প্রার্থীদের নির্বাচন কমিশন বৈধতা দেওয়ার পর আদালত তা বাতিল করছেন। আমরা একজন প্রার্থীকে তো নির্বাচনী এলাকায় পরিচয় করিয়েছি। এখন এসে আমাদের প্রার্থী বাতিল করা হলো। নির্বাচন কমিশন বৈধ ঘোষণার পর আদালত অবৈধ ঘোষণা করায় আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। ইসির ভুলে আমরা কেন শাস্তি পাব! নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘এই অবস্থায় আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে দুইটি প্রস্তাব করেছি। প্রথমত, আমাদের যে আটটি আসনে আদালতের রায়ে প্রার্থী শূন্য হয়ে গেছে সেসব আসনে পুনঃতফসিল দেওয়া হোক অথবা আমাদের অন্য যে বৈধ প্রার্থী ছিলেন তাদের মধ্য থেকে প্রার্থিতা দেওয়া হোক। নির্বাচন কমিশন আমাদের বক্তব্য শুনে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছে।’

রিটার্নিং কর্মকর্তা ও নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তে বিএনপির যেসব প্রার্থী বৈধ হয়েছেন তাদের মধ্যে অন্তত আটটি আসনের আটজন প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করেছেন আদালত। বিএনপির প্রার্থী শূন্য আসনগুলোর মধ্যে আছে জামালপুর-৪, বগুড়া-৩, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪, রংপুর-১, ময়মনসিংহ-৮, ঝিনাইদহ-২, জয়পুরহাট-১ ও রাজশাহী-৬।

তাছাড়া জামায়াতের ২৫ জন প্রার্থীর বিষয়ে আদালতে নির্দেশনা আসায় নতুন করে জঠিলতায় মুখে পড়তে যাচ্ছে ঐক্যফ্রন্ট। সেটিকে সরকারের ষড়যন্ত্র বলেই দেখছে বিএনপি। তবে এ বিষেয়ে গত বুধবার রাতে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম একটি বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, আদালত ব্যবহার সরকার নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে। মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারদলীয় একজন আইনজীবী ধানের শীষ প্রতীকের ২৩ জন প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের জন্য রিট করেছেন। বিরোধী দলের প্রার্থীদের আদালতের দোহাই দিয়ে অযোগ্য করে বিনা নির্বাচনে ক্ষমতা দখলের ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যে এই রিট করা হয়েছে।

তিনি বলেন, দেশের সংবিধান এবং সর্বোচ্চ আদালতে নির্বাচনের বিষয়ে তফসিল ঘোষণার পর উদ্ভূত যেকোনো আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য নির্বাচন ট্রাইব্যুনাল ছাড়া আর কোনো কর্তৃপক্ষের বিবেচনার সুযোগ নেই। মনোনয়নপত্র দাখিল, বাছাই, নির্বাচন কমিশনে আপিল ও প্রার্থীর অনুকূলে প্রতীক বরাদ্দ শেষের পরে প্রার্থীদের প্রার্থিতার বিরুদ্ধে আবেদন তৈরি ও তা নিষ্পত্তির জন্য আদালতকে ব্যবহার নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রের অংশ।

দলীয় এজেন্ট বাছাই : বর্তমান পরিস্থিতিতে ভোটকেন্দ্রে দলীয় এজেন্টের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় বিএনপি। এজন্য আগে থেকেই যোগ্যদের বাছাই করা হয়েছে। তবে যেভাবে গ্রেফতার-নির্যাতন চলছে তাতে সব কেন্দ্রে ধানের শীষের এজেন্ট নিশ্চিত করা জটিল হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান। এরপরও ভোটকেন্দ্রে এজেন্ট ও ভোটারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছেন তারা। প্রতি ভোটকেন্দ্রে নির্ধারিত এজেন্টের বিপরীতে তিনগুণ এজেন্ট প্রস্তুত করা হচ্ছে। দলটির লক্ষ্য ভোটকেন্দ্রে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা এক এজেন্টকে বের করে দিলে বিকল্প এজেন্ট যাতে দায়িত্ব পালন করতে পারে।

ভোটকেন্দ্র পাহারায় কমিটি গঠন : বিভিন্ন অনিয়ম ও জাল ভোট প্রতিরোধসহ ভোট গণনা পর্যন্ত ভোটকেন্দ্র পাহারার জন্য কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি তৈরির কাজ শুরু করেছে বিএনপি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে কমিটি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। সূত্র মতে, এরই মধ্যে পাহারা কমিটিতে নাম দিতে কেন্দ্র থেকে জেলা ও উপজেলায় চিঠি পাঠানো হয়েছে। আগামী ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে কমিটির কাজ চূড়ান্ত করা হবে। তবে কৌশলগত কারণে এ মুহূর্তে কমিটির তালিকা প্রকাশ করা হবে না। নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তে কমিটির তালিকা সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। ভোটকেন্দ্র পাহারা কমিটিতে নারী ও সাহসী নেতাকর্মীদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ভোটকেন্দ্রের আশপাশে নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের সমন্বয়ে প্রতিরোধ কমিটিও প্রস্তুত রাখা হবে বলে জানা গেছে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
নির্বাচন,ভোট,ঐক্যফ্রন্ট
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close