গাজী শাহনেওয়াজ

  ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনে ইসি গলদ্ঘর্ম

হজ করার উদ্দেশে পবিত্র মক্কানগরী গিয়েছিলেন মোহাম্মদ আবদুস উদ্দীন খান। কিন্তু দাদা ও নানার দেওয়া বাবা-মায়ের নাম তার কাছে মনে হয়েছিল সেকেলে। আগে-পিছে না ভেবেই চটজলদি মৃত বাবা-মায়ের নামই বদলে জাতীয় পরিচয়পত্রে বসিয়ে দেন নিজের পছন্দের নাম। মৃত বানিজ খান বদলে বাবার নাম দেন আবদুল্লাহ এবং মৃত বায়লা বিবি বদলে দেন আমেনা বেগম। এনআইডি কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে হুঁশ ফিরেছে আবদুস উদ্দীন খানের। সময়ের সঙ্গে পাল্টেছে তার ভুলও। দাদা-নানার রাখা নামেই ফিরতে জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের জন্য আবেদন করেছেন তিনি। যার নং-১৯৪৭৯৩১০৯৮৩১১৯২৩৫। তবে শুধু আবদুসই নন, তার মতো অনেকেই এ রকম নানা কা- ঘটিয়েছেন। যার মাশুল দিতে হচ্ছে তাদেরই। মো. আলাউদ্দীন আল মাসুম। যার পরিচয়পত্র নং ৫৯১৭৪৪০০৫৬০৭৫। তিনি নাম ও জন্মতারিখ, শিক্ষাগত যোগ্যতা তিনটিরই পরিবর্তন চান। মো. আলাউদ্দীন আল মাসুম বদলে ফিরতে চান এমএ মাসুম বেপারীতে। ১৯৭৭ সালের ১৫ জুন পরিবর্তন করে ১৯৮৪ সালের ১ এপ্রিল তার জন্ম সাল করার আবেদন করেন। এ ছাড়া শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি উল্লেখ করলেও এখন তার দাবি তিনি অষ্টম শ্রেণি পাস। আর জাহাঙ্গীর মোল্লা নাম পরিবর্তন করে রাখতে চান মো. হাফিজুর মোল্লা।

যার নং-৫৯১৭৪৪০০৬০৫৪২। তিনি ২০১৫ সালের জন্মনিবন্ধন সনদ এবং জমির দলিলপত্র ছাড়া নাম পরিবর্তনের স্বপক্ষে প্রয়োজনীয় আর কোনো কাগজপত্র হাজির করতে পারেননি। একইভাবে মো. মোরসালিন মোল্লা নিজের জন্মসাল পরিবর্তন করতে চান। জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্মতারিখের সঙ্গে সংশোধনের আবেদন করা তারিখের ব্যবধান ১০ বছর। মোরসালিনের বর্তমান জন্মতারিখ ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি তা সংশোধন করে ১৯৮৮ সালের ১ জানুয়ারি ফিরে যেতে চান। তবে কমিশন তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখতে পেয়েছে তার শারীরিক গঠনের সঙ্গে সংশোধিত জন্মতারিখটি বেমানান।

আবদুস উদ্দীন, আল মাসুম কিংবা মোরসালিনের জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনে আবেদন করা তথ্যে যে ত্রুটি বা গরমিল, তা ভয়াবহ। গত পাঁচ বছর আগে থেকে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) উপজেলা/জেলা কিংবা ঢাকায় এনআইডি উইংয়ে জমা ১ লাখ ২১ হাজার জাতীয় পরিচয়পত্র এ ধরনের অসংখ্য বিভ্রান্তিমূলক তথ্য যাচাইয়ে খুঁজে পাচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া জমা হওয়া আবেদনপত্রের মধ্যে ৮০ হাজার আবেদনকারীর পরিচয়পত্রে গুরুতর ত্রুটিপূর্ণ, যা সংশোধনে অযোগ্য। যার মধ্যে জন্মতারিখ সংশোধনে ভয়াবহ চিত্র দেখতে পাচ্ছে সংশোধনকারী কর্তৃপক্ষ। একজন ভোটার নিজের জন্মতারিখ সংশোধন চেয়ে আবেদন করেছেন। তবে তথ্য যাচাইয়ে দেখতে পাওয়া গেছে সংশ্লিষ্ট আবেদনটি সংশোধন করা হলে মা-ছেলের বয়সের তফাৎ হবে ছয় বছর। অপরজনের ভোটারে থাকা জন্মতারিখটি সংশোধন হলে বড় ভাই তার সংশোধিত বয়স অনুযায়ী ছোট হয়ে যাবে। তবে নাম, বাবা-মা কিংবা জন্মতারিখ সংশোধন চাইছেন উপযুক্ত প্রমাণ হাজির করতে অপারগ আবেদনকারী। এনআইডি কর্তৃপক্ষ বলছে, ভোটারদের খামখেয়ালিপনা; যার মাশুল তাদেরকেই দিতে হবে।

জানতে চাইলে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের পরিচালক (অপারেশন) মো. আবদুল বাতেন এ প্রসঙ্গে প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের জন্য যে আবেদন জমা ছিল তার মধ্যে অনেকগুলো দীর্ঘদিনের। যতটা না উপজেলা, জেলা কিংবা এনআইডি উইংয়ের সমস্যা, তার চেয়ে বেশি আবেদনকারীর। কারণ যারা সংশোধনের জন্য আবেদন করছেন তারা উপযুক্ত প্রমাণসহ নথিপত্র জমা দিচ্ছেন না। দেখা গেছে, কেউ পুরো নাম, বাবার নাম এবং জন্মতারিখ পরিবর্তন করতে চাচ্ছেন, কিন্তু তার স্বপক্ষে যে কাগজপত্র দেওয়ার কথা তা দিচ্ছেন না। ফলে এসব আইডি সংশোধন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। যিনি ভোটার হয়েছেন তিনি কিন্তু আইনগতভাবে ২নং ফরমটা স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে পূরণ করেছেন। এটা কিন্তু আইনের অংশ। যিনি আইনের অংশ হিসেবে ভোটার হয়েছেন, তিনি আবার বলছেন তার পরিচয়পত্রটি ঠিক নয়। যিনি আগে বলেছেন তার সত্যটি সঠিক ছিল, এখন বলছে সঠিক নয়, তাহলে যিনি বলছেন সঠিক নয়, তার উচিত এর স্বপক্ষে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রদর্শন করা। অথচ সেটিও তারা করছেন না। যিনি সংশোধন কর্তৃপক্ষ তার উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া সংশোধনের এখতিয়ার নেই। তবু আমরা যেসব ছোটখাটো সংশোধন রয়েছে, সেগুলো তাৎক্ষণিক সংশোধন করে দিচ্ছি। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় ১৫-২০ বছরের বয়সের তফাৎ, আবার বড় ভাইয়ের চেয়ে ছোট ভাইয়ের বয়স বেশি হয়ে যাচ্ছে এবং মায়ের সঙ্গে ছেলের বয়সের তফাৎ ৬-৭ বছর। কিছু কিছু মানুষ পরিচয়পত্র সংশোধন এমনভাবে চান যেন তাদের স্বার্থের জন্য। এ বিষয়ে আমরা সতর্কভাবে কাজ করছি। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে এ ধরনের ১ লাখ ২১ হাজার আবেদন জমা ছিল। সেগুলোকে নিষ্পন্ন করার উদ্যোগ নিয়েছি। দেখা গেছে, জমা আবেদনগুলোর মধ্যে ৮০ হাজার সংশোধন সম্ভব নয়। যেগুলো সংশোধন সম্ভব নয়, তাদেরকে তাৎক্ষণিক জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পরবর্তীতে চাইলে উপযুক্ত কাগজপত্র সংগ্রহ করে পুনরায় তারা সংশোধনের আবেদন করতে পারবেন বলে জানান ইসির এই উপসচিব ও এনআইডির পরিচালক অপারেশন।

জানা গেছে, জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের ক্ষেত্রে জটিল কিছু সমীকরণ তাদের সামনে হাজির হয়েছে। গত ৫ বছর আগে থেকে এ ধরনের আবেদন জমা হতে হতে এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে লক্ষাধিক। সম্প্রতি দীর্ঘদিন অনিষ্পন্ন এসব বিদঘূটে পরিচয়পত্র সংশোধনযোগ্য কিংবা অযোগ্য তা নির্ণয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এইআইডির ভাষায় যাকে ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ বলা হচ্ছে। চলতি ফেব্রুয়ারির মধ্যে এগুলো নিষ্পন্ন করার কাজ চলছে। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১৫ হাজারের মতো নিষ্পন্ন হয়েছে। পাশাপাশি যেসব আবেদন সংশোধনযোগ্য নন, সেগুলোকে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর জন্য অফিস সময়ের পর সংশ্লিষ্টদের গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ভোটারদের খামখেয়ালির মাশুল এখন তাদের দিতে হচ্ছে। কেউ অপরিণত বয়সে বিদেশে যাওয়ার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম পরিবর্তন এবং বয়স বাড়িয়ে দিয়েছেন। এখন দেশে আসার পর যখন দেখছেন সম্পত্তি ভাগাভাগি হচ্ছে তখন পরিচয়পত্র সংশোধন করে আগের স্থানে চলে যেতে চাইছেন। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র একটি স্পর্শকাতর। তাই সঠিক তথ্য-প্রমাণ ছাড়া কারো চাওয়ামাত্রই এটি সংশোধন করা হলে অনেকেই সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবেন, আবার কেউ অন্যের সম্পত্তি নিজের করে নেবেন। তাই তাদের খামখেয়ালির মাশুল তাদেরকেই দিতে হবে। এর দায় এনআইডি নেবে না। তবে যেগুলো জেনুইন সংশোধনযোগ্য, তা সংশোধনে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে না।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist