নিজস্ব প্রতিবেদক
ঘিঞ্জি ও অবৈধ দখলে তেজগাঁও নাখালপাড়া
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অন্যতম ব্যস্ত, জনবহুল ও ঘনবসতিপূর্ণ তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়া এলাকা। ওই এলাকার পাশে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়, সংসদ সদস্যদের হোস্টেল, পুরাতন এয়ারপোর্টসহ রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এলাকায় একদিকে রয়েছে মিল কলকারখানা, সেই সঙ্গে আবাসিক ভবন। অথচ সেখানে নেই কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা।
কয়েক দিন আগে পশ্চিম নাখালপাড়ায় অভিযান চালিয়ে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে তিন জঙ্গি নিহত হয়। রেলওয়ে বস্তিসহ পুরো এলাকায় চলে মাদকের বেচাকেনা। ঘিঞ্জি এলাকা হওয়ার কারণে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলছে আইনবিরোধী কার্যক্রম। চলছে দখলের উৎসব। এ ওয়ার্ডে নেই পার্ক ও খেলার মাঠ। সামাজিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করার জন্য কমিউনিটি সেন্টার বা কোনো উন্মুক্ত স্থান নেই। আর সড়কে যত্রতত্র আবর্জনার ছড়াছড়ি, সড়ক বেদখল, পুরাতন ও অকার্যকর ড্রেনেজ ব্যবস্থা, চলমান সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি, অকেজো সড়কবাতি ও মশার উপদ্রব—এসবই হলো স্থানীয়দের নিত্যসঙ্গী।
প্রতিদিনই ঘটছে চুরি-ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা। অবৈধ দখল এবং ভ্রাম্যমাণ বাজার গড়ে ওঠার পেছনে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সরকারি দলের নেতাদের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অন্তহীন এ ভোগান্তি দেখেও না দেখার ভান করছেন কাউন্সিলর ও ডিএনসিসি সংশ্লিষ্টরা। স্থানীয়রা বলছেন, সরকারি দল থেকে নির্বাচিত কাউন্সিলরের অসম্ভব প্রভাব থাকায় তাকে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। অবৈধ দখল ও বাণিজ্যের পেছনে তার হাত রয়েছে। পশ্চিম নাখালপাড়া, পূর্ব নাখালপাড়া, শাহীনবাগ, আরজতপাড়া, লিচুবাগান, সমিতি বাজার, বনফুল, সিএনবি, শিয়া মাজার (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পেছনের এলাকা) ও নাখালপাড়া রেলগেট এলাকা নিয়েই ডিএনসিসির ২৯ নম্বর ওয়ার্ড। এ ওয়ার্ডের আয়তন দুই বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা প্রায় দুই লাখ। ভোটার সংখ্যা প্রায় ৬৮ হাজার, হোল্ডিং প্রায় তিন হাজার। ওয়ার্ডে একটি কবরস্থান আছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তিন মেয়াদে ১৯ বছর ধরে ২৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে রয়েছেন শেখ মজিবুর রহমান। পূর্ব নাখালপাড়ার আদি বাসিন্দা হিসেবে এলাকার শিক্ষা, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার পূর্বপুরুষদের নাম। আওয়ামী লীগের এ নেতা রাজনীতি ও পারিবারিক কারণে এলাকায় নিরঙ্কুশ প্রভাবশালী। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর হিসেবে তিনি প্রভাব খাটিয়ে যাচ্ছেন।
আরো জানা যায়, ২০১৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর নাখালপাড়া রেললাইনসংলগ্ন অবৈধ কাঁচাবাজার উচ্ছেদ করতে এসে বাধার মুখে পড়ে ডিএনসিসি। ডিএনসিসির ২৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ মজিবুর রহমানের কারণে অভিযান প- হয়ে যায়। কাঁচাবাজারের জমিকে কাউন্সিলর নিজের সম্পত্তি দাবি করে উচ্ছেদে বাধা দেন। পূর্ব নাখালপাড়া রেললাইনের দুপাশে রেল বিভাগ এবং ডিএনসিসির জমিতে দোকানপাট তুলে অবৈধভাবে অর্থ আয় করছেন মজিবুর রহমান। ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম সে সময় সাংবাদিকদের জানান, পূর্ব নাখালপাড়া ডিএনসিসির সম্পত্তিতে গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে গেলে স্থানীয় ২৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ওই জায়গার মালিকানা দাবি করেন। এ কারণে সেখানকার সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে পারেননি তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পূর্ব নাখালপাড়ার এক বাসিন্দা বলেন, ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রভাবশালী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে পারেন না। তিনি অবৈধভাবে ভ্রাম্যমাণ বাজার ও রেললাইনের পাশে দোকান বসিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এলাকায় যত অবৈধ কার্যক্রম হচ্ছে সবগুলোর পেছনে তার হাত রয়েছেও বলে অভিযোগ করেন তিনি। আর ওয়ার্ডের নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টাও করেন না কাউন্সিলর।
সরেজমিন দেখা যায়, শিয়া মাজার এলাকার সড়কগুলো খানাখন্দে ভরা। লুকাসের মোড়ে সড়ক ও ফুটপাত দখল করে রাখা হয়েছে ভ্যানগাড়ি, বিভিন্ন ধরনের ফেরি করা গাড়ি। এ ছাড়াও রয়েছে চায়ের দোকান, জুতা পালিশের দোকান ও আওয়ামী মোটরচালক লীগের অফিস।
পশ্চিম নাখালপাড়া এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বেলাল মসজিদ গলিতে ময়লার স্তূপ, সেখান থেকে ময়লার দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। পশ্চিম নাখালপাড়া লুকাসের মোড় হতে পূর্ব নাখালপাড়া নাবিস্কো মোড় পর্যন্ত সড়কে কোনো ফুটপাত নেই। সড়কের দুপাশে অসংখ্য দোকানপাট। এর মধ্য দিয়ে পথচারী ও যানবাহন চলাচল করছে, যার ফলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। নাবিস্কো থেকে রেললাইন হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে রাস্তাতে সারা দিন যানজট লেগেই থাকে।
এ ছাড়া পশ্চিম নাখালপাড়ার ৬, ৮, ৯ ও ১০ নম্বর সড়ক ঘুরে দেখা যায়, ৬ নম্বর সড়কটি খানাখন্দে ভরা। এলোমেলোভাবে সড়কের মধ্যে বাঁশ, কাঠ, রড, সিমেন্ট, বালু ফেলে রাখা হয়েছে। কয়েকটি সড়কে চলছে সংস্কারকাজ। কাজের মন্থরগতির কারণে অন্তহীন ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে ওয়ার্ডবাসীকে। ৭৫ জন পরিচ্ছন্নকর্মী ও পর্যাপ্ত ময়লার ভ্যান থাকার পরও ওয়ার্ডের অনেক অঞ্চল অপরিষ্কার। শাহীনবাগ প্রধান সড়কে খোলা আকাশের নিচে ফেলা হচ্ছে ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের সব আবর্জনা। আবর্জনার দুর্গন্ধে পথচারী ও ওই এলাকার বাসিন্দাদের সব সময় নাক চেপে চলাফেরা করতে হচ্ছে। বৃষ্টির পর ওই সব সড়কে দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে।
দখল-বেদখল বাণিজ্যের পাশাপাশি ওয়ার্ডে মাদক ব্যবসাও জমজমাট। ভাসমান লোকজনের আনাগোনা আর কর্মব্যস্ত মানুষের ভিড়ে দিব্যি হাতবদল হচ্ছে মাদক। মাদক কারবারে বেশ পরিচিতি পেয়েছে ওয়ার্ডের মাউরার টেক বস্তি ও নামাপাড়া। সব ধরনের মাদক মেলে এই ওয়ার্ডে। তবে ইয়াবার চাহিদা বেশি। রেলওয়ের বস্তিসহ আশপাশের গলিগুলোতেও সরব মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীরা। বস্তিতে দিনের আলোতেও চলছে মাদক কেনাবেচা। পুলিশ বিভিন্ন সময় অভিযান চালালেও ওয়ার্ডে কমেনি মাদকচক্রের দাপট। এ ছাড়া একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি উচ্চবিদ্যালয়, একটি কলেজ আর কিন্ডারগার্টেন নিয়ে ওয়ার্ডে ২০টির বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। ওয়ার্ডের ড্রেনেজব্যবস্থারও করুণ হাল। ওয়াসার পানিতেও দুর্গন্ধ। গ্যাসের ভোগান্তিও কম নয়। এ নিয়ে সর্বোচ্চ দুর্ভোগে আছেন পশ্চিম-পূর্ব নাখালপাড়ার বাসিন্দারা।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ২৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ মজিবুর রহমানকে কার্যালয়ে গিয়ে পাওয়া যায়নি। পরে ফোনে কথা বলতে চাইলে তিনি অস্বীকৃতি জানান। এবং কিছু জানার থাকলে ওয়ার্ড সচিবের কাছ থেকে জেনে নেন বলে ফোন কেটে দেন।
পিডিএসও/তাজ